হাসলো দোকানদার। না, ভাই, এতো কম না। সবচেয়ে কম, দশ হাজার। আসলে, জাহাজ হিসেবে বিক্রি করি আমরা। এক জাহাজ এতো, দুই জাহাজ এতো, এভাবে। এই তো, কাল সকালেই তিন জাহাজ মাল চালান দিলাম। আজ সকালেই ছেড়ে যাওয়ার কথা ওগুলোর।
কোত্থেকে? আই মীন, কোন বন্দর থেকে?
ওল্ড হারবার।
দেখুন, আমরা এখানে নতুন। মোমবাসা দেখতে এসেছি। চিনিটিনি না কিছু..।
সোজা চলে যাও। বন্দরটা এই পথের শেষ মাথায়।
.
দ্বীপের উত্তর-পূর্ব কোণে, প্রবালের দেয়াল ঘেরা একটা বেসিন মতো জায়গায় তৈরি হয়েছিলো মোমবাসার ওল্ড হারবার বা পুরনো বন্দর। গা ঘেষাঘেষি করে নোঙর করে আছে অসংখ্য আরব ডাউ। বড় বড় এই জাহাজগুলোর পেছনে পুরনো ধাচের উঁচু মঞ্চ দেখলে জলদস্যু আমলের কথা মনে পড়ে। কোন-কোনটা ছাড়ার জন্যে তৈরি, দেখলেই বোঝা যায়। বিশাল ল্যাটিন পাল তুলে দেয়া হয়েছে, পতপত করছে বাতাসে।
ছাড়তে প্রস্তুত, ওরকম ডাউগুলোর সবচেয়ে বড়টার গ্যাঙওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে বাদামী-চামড়ার এক আরব। চেহারা, পোশাক-আশাকে ছেলেদের মনে হলো, কবর থেকে উঠে এসেছে বুঝি সেই তিনশো বছর আগের কোনো জলদস্যু সর্দার।
কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তিন গোয়েন্দা। কিশোর জিজ্ঞেস করলো, আপনিই বোধহয় এই জাহাজের ক্যাপ্টেন?
মাথা ঝাঁকালো লোকটা।
অভিনয় শুরু হয়ে গেল। অলসভঙ্গিতে দুলছে জাহাজের মস্ত পাল, সেদিকে চেয়ে বিস্ময়ে বড় বড়, হলো কিশোরের চোখ। কাঁধ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে অনুরোধ করলো, ছবি তুলি?
নীরবে মাথা কাত করলো ক্যাপ্টেন।
ছবি তুললো কিশোর। জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যাবেন?
বমবাই।
বোম্বে? ভালো। খুব সুন্দর আপনার জাহাজটা। পাল আরও সুন্দর। এখান থেকে সুবিধে হচ্ছে না। ডেকে উঠে যদি তুলি, কিছু মনে করবেন?..
হাত নেড়ে ডেক দেখিয়ে দিলো ক্যাপ্টেন, অর্থাৎ যাও। লোকটা যদি মত বদলায়, এই ভয়ে এক মুহূর্ত দেরি করলো না কিশোর। মুসা আর রবিনকে নিয়ে ডেকে উঠে এলো। আরও দুটো ছবি তুলে ফিরে চেয়ে দেখলো, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ক্যাপ্টেন। চট করে তারও একটা ছবি তুলে নিলো। হাসিতে বিগলিত হলো লোকটার মুখ, গোয়েন্দাপ্রধানের মনে হলো, হাসিটাও জলদস্যুদের মতো।
বোম্বেতে কি নিয়ে যাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
সত্যি কথা শুনবে, আশা করেনি সে। কিন্তু লুকোছাপার ধার দিয়েও গেল না ক্যাপ্টেন। বোঝা গেল, গুপ্তচর, সাদা পোশাকে পুলিশ কিংবা কাস্টমের লোকের ভয় করছে না। ভয় করার কারণই নেই হয়তো। চলো, দেখাচ্ছি।
টান দিয়ে একটা তারপুলিনের কোণা তুললো ক্যাপ্টেন। ফাঁক দিয়ে দেখা গেল নিচের ডেক। খোলে বোঝাই হয়ে আছে জন্তুজানোয়ারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, খানিক আগে দোকানটায় যা দেখে এসেছে তিন গোয়েন্দা, সেসব জিনিস। গর্বের হাসি ফুটলো জলদস্যুর মুখে। দারুণ, না?
জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো কিশোর, কতোগুলো আছে এখানে? পোচার।
দেখতে হবে, বলে, গিয়ে বিল অভ লেডিং বের করে আনলো লোকটা। কোন জানোয়ারের কয়টা অঙ্গ আছে, কত টাকার জিনিস, সব লেখা আছে। হিসেব করে জানালো সে, অন্তত এক লাখ আশি হাজার জানোয়ার মেরে জোগাড় করতে হয়েছে ওগুলো।
স্তব্ধ হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। যে তিনটা জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার কথা, তার একটাতেই আছে ওই পরিমাণ মাল! কি হারে জানোয়ার মারা হচ্ছে, ভেবে এই গরমের মাঝেও গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো কিশোরের, শীত শীত লাগলো।
.
কিছুই বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়লেন ওয়ারডেন, তিন গোয়েন্দার রিপোর্ট শুনে। নির্মল ওরকম করলো কেন? আসলে ওর মনটা বেশি নরম, কারো কষ্ট সইতে পারে না। না জানোয়ারের, না মানুষের। জজ না হয়ে ঋষি হওয়া উচিত ছিলো তার। দেখি, দেখা হলে জিজ্ঞেস করবো, বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। তিনি। মুসা, আরেকবার কষ্ট করতে হবে তোমাকে। প্লেনে করে দুটো যাত্রীকে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। ইচ্ছে করলে তোমরাও যেতে পারো, রবিন আর কিশোরের দিকে ইঙ্গিত করলেন।
আবার প্লেন নিয়ে বেরোতে পারবে শুনে খুব খুশি মুসা। জিজ্ঞেস করলো, যাত্রীরা কে?
এসো, দেখাচ্ছি।
.
১৩.
জানোয়ারের হাসপাতালে তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে এলেন টমসন। ঘড়ঘড়, গোঁ গোঁ, ঘোৎ ঘোৎ, চি চি, কিউ কিউ আর আরও নানা রকম বিচিত্র শব্দ হচ্ছে হাসপাতালে। রোগী নানা ধরনের আফ্রিকান জন্তুজানোয়ার।
আফ্রিকার সুন্দরতম বানরের সঙ্গে পরিচিত হও, হেসে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন ওয়ারডেন। ইনি মিস্টার কোলোবাস।
বানরটা সত্যি খুব সুন্দর। কোলোবাস মাংকি আগেও চিড়িয়াখানায় দেখেছে। তিন গোয়েন্দা, তবে ওগুলো কোনোটাই এটার মতো সুন্দর নয়। বন থেকে সদ্য এসেছে তো। সব জীবই তার প্রিয় প্রাকৃতিক পরিবেশে অন্যরকম থাকে। কুচকুচে কালোর মাঝে তুষার-শুভ্র ছোপ যেন ফুটে রয়েছে। পিঠের নিচে, পেটের সামান্য ওপরে আর মুখমণ্ডলে ওই সাদা রঙ। লেজের ডগায় ফোলা রোমগুলোও সাদা।
সাংঘাতিক সুন্দর তো! অবাক হয়ে দেখছে রবিন।
হ্যাঁ, মাথা ঝোঁকালেন টমসন। আর এ-কারণেই মরতে হচ্ছে এগুলোকে। খুব চাহিদা, মহিলাদের পোশাক তৈরি হয়। দামও অনেক বেশি। ফলে পোচাররা লেগে আছে পেছনে। কোলোবাসের বংশ নির্বংশ করার প্রতিজ্ঞা করেছে যেন। অনেক কমে গেছে ওরা, খুব সামান্যই আছে আর। শীঘ্রি পোচিং থামাতে না পারলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, ডোডো পাখির মতো নামটাই শুধু অবশিষ্ট থাকবে।