আছে, একমত হলেন ইংরেজ ওয়ারডেন। এবং সব জায়গাতেই শয়তানও আছে। ওরা না থাকলে…এই টিসাভোর কথাই ধরো, পোচারগুলো না থাকলে সত্যি স্বর্গ বলা যেতো জায়গাটাকে। জানোয়ারের নিরাপদ বাসভূমি, টুরিস্টদের আনন্দ। ওই যে নদীটা, একটা জায়গায় বেশি ছড়ানো দেখছো, ওখানে একটা আণ্ডারওয়াটার অভজারভেটরি আছে। ওখান থেকে নদীর নিচের দৃশ্য দেখা যায়। এখন আর সুন্দর কিছু দেখবে না, পোচাররা সর্বনাশ করে দিয়েছে। ডজন ডজন জলহস্তী মেরে… দৃশ্যটা কল্পনা করে চেহারা বিকৃত করে ফেললেন তিনি।
মেরে ফেলে ওদের কি লাভ? জানতে চাইলো মুসা।
ওদের যা দরকার নিয়ে চলে গেছে। জলহস্তীর একেকটা মাথার দাম চার পাঁচ হাজার ডলার। চামড়ার দামও অনেক। মাথা কেটে, চামড়া ছিলে, ধড়টা। ফেলে রেখে গেছে।
নরপিশাচের দল! দাঁতে দাঁত চাপলো কিশোর। খেতে যদি, তা-ও এক কথা ছিল, শুধু কিছু টাকার জন্যে এভাবে খুন করে জানোয়ারগুলোকে!
ওদের পিশাচ বললে কম বলা হয়, টমসন বললেন। জানোয়ারের ব্যবসা করে কোটিপতি হয়ে, গেল একেকজন মানুষের জন্যে শিকার নিষিদ্ধ নয়, কোনোকালেই ছিলো না। আদিম যুগেও শিকার করতো মানুষ, মাংসের জন্যে, খেয়ে বাঁচার তাগিদে। আফ্রিকায় এখনও অনেক উপজাতি আছে, শিকার না পেলে যারা না খেয়ে মরবে। তাদের শিকারে কিছু হয় না, জন্তুজানোয়ারের বংশ। লোপ পাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। বড় একটা হরিণ মারতে পারলে এক-গা লোকের খাওয়া হয়ে যায়। আর ঘরে খাবার থাকলে অহেতুক জানোয়ারও মারে না তারা। কিন্তু ওই পোচাররা তো তা করে না। পালে পালে মারে। যতো বেশি। মারতে পারবে, ততোই পয়সা। জানোয়ার খুন করার জন্যে রীতিমতো আর্মি বানিয়ে নিয়েছে ওরা, থামলেন ওয়ারডেন। তারপর বললেন, টিসাভোর পোচারদের সর্দারের নাম লঙ জন সিলভার। অবশ্যই ছদ্মনাম। ট্রেজার আইল্যাণ্ডের সেই কুখ্যাত জলদস্য সিলভারের নাম নিয়েছে। তফাত শুধু স্টিভেনসনের ডাকাতটা লুট করতে সোনার মোহর, আমাদের ডাকাতটা করে জানোয়ারের দাঁত-মাথা-হাড়-চামড়া।
সিলভারের আসল পরিচয় জানেন? জিজ্ঞেস করলো কিশোর।
না। পরিচয় তো দুরের কথা, তার আসল চেহারাই নাকি কেউ দেখেনি। বিদেশী, না আফ্রিকান, তা-ও জানি না। আশা করি, এই রহস্যের সমাধান তোমরা করতে পারবে।
চেষ্টা করবো।
মোমবাসা থেকে জাহাজে করে পৃথিবীর বড় বড় শহরে পাচার হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য জলহস্তীর মাথা, গাদা গাদা হাতির দাঁত, গণ্ডারের শিং; চিতাবাঘ, বানর, পাইথনের চামড়া। মাঝেসাঝে কিছু কিছু মাল আটক করা হয়, দুএকটা চুনোপুটি ধরাও পড়ে, কিন্তু আসল লোকটার পাত্তাও পাওয়া যায় না। যাদেরকে ধরা হয়, তারাও কিছু বলতে পারে না। হয়তো সে মোমবাসার কোনো ধনী ব্যবসায়ী, কিংবা এ-দেশের কোনো উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার আর্মি গড়তে তাই তার। সুবিধে হয়েছে। তবে সবই অনুমান। তাকে না ধরা পর্যন্ত কোনো কিছুই শিওর হয়ে বলা যাবে না।
.
০২.
বিমানটা জার্মানীর তৈরি, চার সীটের একটা স্টর্ক বিমান। ডুয়্যাল কনট্রোল। জয়স্টিকের এক মাথা ধরে রেখেছেন টমসন। আরেক মাথা কো-পাইলটের সীটে বসা মুসার দুই হাঁটুর ফাঁকে। সতৃষ্ণ নয়নে বার বার ওটার দিকে তাকাচ্ছে মুসা, চেপে ধরার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে রোধ করছে। চালাতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। তার। কিছু দিন ধরে প্লেন চালানো শিখছে সে। ওগুলো সব আমেরিকান প্লেন, এটা জার্মান। ইনস্ট্রমেন্ট প্যানেলের সমস্ত যন্ত্রপাতির তলায় আর মিটারের লেখা জার্মান ভাষায়, বেশির ভাগই পড়তে পারে না। তাছাড়া যন্ত্রপাতিগুলোও কেমন যেন এলোমেলো, আমেরিকানগুলোর সঙ্গে মিল কম। পারবে, ভাবলো মুসা, সময় লাগবে আরকি। প্র্যাকটিস করতে হবে।
ওই যে উঁচু পাহাড়টা, দেখালেন ওয়ারডেন। চোখা চূড়া।
হ্যাঁ, দেখছি, মুসা বললো। ওপরে প্যাভিলিয়ন মতো কি যেন।
প্যাভিলিয়নই। তাতে টেলিস্কোপ বসানো। একে আমরা বলি পোচারস লুকআউট। ওই টেলিস্কোপ দিয়ে সারাক্ষণ নজর রাখে রেঞ্জাররা, পোচার আছে কিনা দেখে।
কতদূর দেখা যায় ওখান থেকে? মুসার পেছনের সীট থেকে জিজ্ঞেস করলো রবিন।
বেশি না, জবাব দিলেন টমসন। মাত্র কয়েক মাইল। আরও বেশি যেতো, বন আর পাহাড়ের জন্যে পারা যায় না। চোখের সামনে বাধা হয়ে যায়। না হলেও বা আর কতদূর দেখতাম? আট হাজার মাইল এলাকা, পুরোটা দেখতে হলে কয়েক শো লুকআউট দরকার। সেটা অসম্ভব। অতো জোগান দিতে পারবে না। সরকার। লোকই দিতে পারে না। ছিলো বাইশ জন, বারো জন শেষ। এরপর কতো লেখালেখি করছি, লোকের জন্যে। অবশেষে রাজি হয়েছে। কাল-পরশু আরও বিশ-তিরিশজন পাবো আশা করি।
পাহারা দেয়া হয় তাহলে কি করে? পেছন থেকে জানতে চাইলো কিশোর। প্লেন নিয়ে ঘোরেন সারাদিন?
সারাদিন হয় না। শুধু আমি চালাতে পারি এটা। পোচার দেখা ছাড়াও আরও অনেক কাজ আছে আমার। তবু সময় পেলেই উড়ি।…আমাদের ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে। পোচারস লুকআউটের ওপাশে।
সামনে মাইল পাঁচেক দূরে কতগুলো কেবিন দেখা গেল, কুঁড়ে বলাই ভালো। খড়ের চালা, বাঁশের বেড়া। ওটাই তাহলে বিখ্যাত কিতানি সাফারি লজ! অবাক হলো তিন গোয়েন্দা। টুরিস্ট মৌসুমে এখানেই এসে দলে দলে ভিড় জমায়। ইউরোপ-আমেরিকার লোকেরা! আর দশটা খুদে আফ্রিকান গ্রামের সঙ্গে বিশেষ, তফাত নেই ক্যাম্পটার।