মাথা নাড়লো কিশোর। বুঝতে পারছি না। লোকটাকে দেখে মনে হয় না খারাপ। সিলভারের মতো বাজে লোকের সঙ্গে নাহ, বিশ্বাস হয় না। আরেকটা কথা ভাবছি। মায়াদরদ দেখিয়ে শয়তানকে পথে আনার চেষ্টা করছেন হয়তো…
গোড়ার ডিম করছেন! বুড়ো আঙুল নাচালো মুসা। হাজী মোহাম্মদ মহসীন সেজেছেন! শয়তান কোথাকার!
আহাআ, ভদ্রলোক সম্পর্কে ওভাবে কথা বলা উচিত না।
পথের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে ওরা। তিনজনেই নীরব। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
দেখো, হঠাৎ বলে উঠলো মুসা। তোমার ডিটেকটিভ ব্রেন এখন কোথায়? কাজ করছে না কেন? আমি বলছি, ব্যাটা একটা শয়তান। সিলভারের দোস্ত। ওর মুখোশটা খুলে দেয়া উচিত আমাদের।
মৃদু হাসলো শুধু কিশোর, কিছু বললো না। তার মনে হচ্ছে, মুসার অনুমান ঠিক নয়। অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে জজের এই রহস্যময় আচরণের। সিলভারের দোস্ত নয় লোকটা।
উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে মেন রোড থেকে সরে এলো ওরা। বড় বড় সুন্দর অট্টালিকাগুলো পেছনে পড়লো। ঢুকলো এসে পুরনো শহরের এক সরু গলিতে, আরবদের বসবাস বেশি শহরের এদিকটায়। দোকানগুলোর দরজা খোলা, কিন্তু শো-কেস বা জিনিসপত্র কিছু চোখে পড়ছে না। দরজার পরেই অন্ধকার, যেন অজগরের হাঁ, তার পরে রহস্যময় এক জগৎ, কি আছে বোঝার উপায় নেই। কিছু দোকানের ভেতর থেকে আসছে ফল আর সজির গন্ধ, কোনো কোনোটা থেকে মাংসের। একটা দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অদ্ভুত গন্ধ পেলো মুসা, লোহা, তার, তেলের–হার্ডওয়্যারের দোকানে যেমন থাকে। সে কথা জানালো দুই বন্ধুকে।
পরামর্শ করে দোকানটায় ঢুকলো তিনজনে। ঢুকেই একটা ধাক্কা খেলো যেন। দেয়ালে, মাটিতে যেখানেই চোখ পড়লো, দেখা গেল রাশি রাশি ফাঁদ, জানোয়ার ধরার জন্যে যতো রকম থাকতে পারে। তারের ফাঁস থেকে শুরু করে সব।
কোণের বিষণ্ণ অন্ধকার থেকে হাত ডলতে ডলতে বেরিয়ে এলো লম্বা-নাক এক আরব। কি, ফাঁদের ব্যাপারে আগ্রহ?
খুউব, জবাব দিলো কিশোর। পোচারদের কাছে বিক্রি করেন, না?
মাথা ঝোঁকালো দোকানদার।
কাজটা বেআইনী হয়ে গেল না?
আইন? হা-হা করে হাসলো লোকটা। এই দেশে আবার আইন আছে নাকি? এখানে আইনের কথা যারা বলে তারাই বেআইনী লোক। যাকগে। তোমরা কে? কোনো দল-টল পোষো?
দল?
শিকারীর দল, শিকারী। আইনের লোকদের পোচার। সিলভারের মতো দল।
সিলভারকে চেনেন নাকি?
চিনি না মানে? ও আমার সবচে বড় কাস্টোমার। একেবারে এক হাজারের কম কেনে না।
কতো করে পড়ে দাম?
আড়াই গজী তারের ফাঁস আধ ডলার করে। ওই হিসেবে যতো বড় নাও। তবে একসঙ্গে অনেক নিলে কিছু কম হবে, পাইকারী।
আচ্ছা, বুঝলাম। এখন বলুন, এক হাজার ফাঁস যদি নিই, কততগুলো জানোয়ার ধরতে পারবো?
সেটা সীজনের ওপর নির্ভর করে। আর তাছাড়া একেক শিকারীর একেক রকম হিসাব। সিলভার বলে, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রতি ফাসে হপ্তায়। একটা করে জানোয়ার, মাসে চার। তার মানে, হাজার ফাসে আটাশ হাজার, সাত মাসে। শুকনোর সময়, মানে আগস্ট থেকে অক্টোবরে মাসে একটা। তিন মাসে ধরো আরও তিন হাজার। মাইগ্রেশন সীজনে সবচে বেশি। মাসে দশটা। নভেম্বর, আর ডিসেম্বর শুধু এই দুমাসেই ধরা পড়ে বিশ হাজার। সব মিলিয়ে বছরে হলো গিয়ে একান্ন হাজার।
ভালো ব্যবসা!
খুব ভালো। এদেশের সবচে বড় ব্যবসা।
সবচে বড় শয়তানী! রাগ চাপতে না পেরে ফস করে বলে বসলো মুসা। কিশোরের আরও কিছু জানার ছিলো, দিলো সব ভণ্ডুল করে। জানোয়ারদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখেছো মিয়া, ফাঁসে গলা ঢোকাতে কেমন লাগে?
ক্ষণিকের জন্যে থ হয়ে গেল আরবটা। মানে… মানে…তোমরা জন্তু প্রেমিক! রাগে বেগুনী হয়ে উঠলো চোহারা। হায় হায়, কতো কথা বলে ফেলেছি! এই, বেরোও বেরোও আমার দোকান থেকে! নইলে…
নইলে কি করবে? হাতা গোটাতে শুরু করলো মুসা। আফ্রিকায় এসে যেন জোর বেড়ে গেছে তার, যদিও বাড়ি এখান থেকে অনেক দূরে।
ঝগড়া বাড়তে দিলো না কিশোর আর রবিন। দুজনে মিলে টেনে দোকান থেকে বের করে নিয়ে এলো মুসাকে।
রাস্তাটা ধরে আবার এগোলো ওরা। আরেকটা দোকানের সামনে থমকে দাঁড়ালো কিশোর, তীব্র বোটকা গন্ধ আসছে ভেতর থেকে। ওই গন্ধ তিনজনেরই পরিচিত। মনে করিয়ে দিলো. পোচারদের ক্যাম্পের কথা। কাঁচা চামড়ার স্তূপ, কাটা মাথা…
এই দোকানেও ঢুকলো ওরা। মস্ত ঘর, এক মাথা থেকে আরেক মাথা দেখা যায় না ভালো মতো। মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত স্তূপ করে রাখা হয়েছে নানা জানোয়ারের শরীরের বিভিন্ন অংশ। সিংহ, চিতাবাঘ, চিতা, জিরাফ, মহিষ, জেব্রা, ওয়াইল্ডবীস্ট, গণ্ডার, জলহস্তী আর হরিণের মাথা, হাতির পায়ে তৈরি ময়লা ফেলার ঝুড়ি আর ছাতা রাখার স্ট্যাণ্ড; হাতির দাঁত, গণ্ডারের শিং, সব জাতের বানরের স্টাফ করা দেহ, বিরাট হাতি থেকে খুদে বুশ-বেবি পর্যন্ত প্রায় সব জানোয়ারের চামড়া; আর আরও নানারকম জিনিস।
মালিকের চেহারা দেখেই বোঝা গেল, সে ভারতীয়।
ছোট টমি হরিণের ডালপালা ছড়ানো শিংওয়ালা সুন্দর একটা মাথা তুলে নিলো কিশোর। জিজ্ঞেস করলো, কতো?
কটা চাই?
এটার দাম কতো?
সরি, ইয়াং ম্যান, একটা করে বেচি না। পাইকরী। এটা পাইকারী দোকান।
অ। তা পাইকারী কি হিসেবে? ডজন, শ, নাকি হাজার?