ঘরের শেষ মাথায়, উঁচু মঞ্চের ওপর ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন জজ নির্মল পাণ্ডা। তাকে এখন আর ছোট লাগছে না। পরনের কালো আলখেল্লা আভিজাত্য এনেছে। তার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে সাতচল্লিশ জন পোচারকে। ঘরের। বাকি অংশে সারি সারি চেয়ারে বসে আছে অনেক দর্শক। কোনো জুরি নেই, বাদী পক্ষের উকিল নেই, আসামী পক্ষেরও না। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এখানে। একজন লোক, জজ সাহেব। বাদী পক্ষ সব অসহায় জানোয়ার, তাদের হয়ে কে আর ওকালতি করবে? :
জজ যেন আমাদের দেখতে না পান, ফিসফিসিয়ে বন্ধুদের বললো গোয়েন্দাপ্রাধান। মাথা নিচু রেখে চট করে ঢুকে পড়বে। ও-কে?
নীরবে ঢুকে গেল তিন গোয়েন্দা। চোখের পলকে মিশে গেল চেয়ারের পেছনে দাঁড়ানো জনতার ভিড়ে।
পোচারদের ভাষা বোঝেন না বোধহয় জজ। একজন দোভাষী রেখেছেন। জজের প্রশ্নের জবাবে একজন পোচার যা বললো, সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে। জানালো দোভাষী, ও বলছে, খুব গরীব লোক। আট ছেলেমেয়ে। আরও চারজন আসছে।
চারজন আসছে।
হ্যাঁ। ওর চার স্ত্রী।
ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন জজ। ব্যাটা বুঝতে পারছে, আমি ওকে দশ বছরের জেল দিতে পারি?
পারছে।
বেশ, ভুল যখন বুঝতে পারছে, অনুশোচনা হচ্ছে, মাপ করে দেয়া গেল। তাকে। যোলোজনের ভরণ-পোষণ করতেই ব্যাটার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। জ্বালিয়ে খাক করে ফেলবে তাকে চার স্ত্রী মিলে। জেলের চেয়ে সেটা বড় শাস্তি।
হেসে উঠলো জনতা। ঠিকই বলেছেন জজ, রসিক লোক।
কেস ডিসমিসড, রায় দিলেন বিচারক।
তাঁর এই বদান্যতায় সবাই খুশি হতে পারলো না। কিশোরের পাশে দাঁড়ানো এক আফ্রিকান তরুণ নিচু কণ্ঠে বিড়বিড় করলো, এভাবে পোচিং বন্ধ করতে পারবে নাকি!
মাথা নাড়লো কিশোর, লোকটার সঙ্গে একমত। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এতো কষ্ট করে লোকগুলোকে ধরা হলো এতো সহজে ছেড়ে দেয়ার জন্যে।
আরেকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন জজ, তুমি জানো না, জানোয়ার মারা অন্যায়?
না, দোভাষীর মুখে জবাব দিলো লোকটা। আমার গায়ের লোকেরা সব সময়ই জানোয়ার মারে, না হলে খাবে কি? যুগ যুগ ধরে শিকার চলে আসছে। আমাদের সমাজে, এটা আমাদের প্রথা। আমাদের বাবারা শিকার করেছে, তাদের বাবারা করেছে, তাদের বাবারা করেছে, তাদের বাবারা করেছে, তাদের বাবারা…
আরে থামো, থামো, হাত তুললেন জজ। যাই হোক; ঠিকই বলেছো তুমি। যুগ যুগ ধরে যে নিয়ম তোমার রক্তে মিশে আছে, সেটা আর ভাঙবে কি করে? কেস ডিসমিসড!
পরের লোকটা আরেক কৈফিয়ত দিলো। বললো, আমি খুব ভালো মানুষ, মন নরম। জানোয়ার মারতে একটুও ভাল্লাগে না আমার। কিন্তু সিলভার বাধ্য করে, না মেরে কি করবো?
বিষণ্ণ হয়ে গেল জজের চেহারা। মাথা নেড়ে সহানুভূতি জানিয়ে বললেন, তাই তো, কি করবে? ওরকম একটা খুনীর বিরুদ্ধে-নিজের ইচ্ছেয় সত্যি মারো না তো?
না।
সিলভারটা একটা আস্ত শয়তান। ওকে নিশ্চয় খুব ভয় করো?
আমরা সবাই করি।
গুড। মানে…, চট করে জনতার দিকে তাকালেন জজ। তুমি নিজের ইচ্ছেয় করো না তো, সে জন্যে গুড বললাম। যে অপরাধ মন থেকে করোনি, সেটার শাস্তি দিই কি করে? আর কোনদিন করো না। কেস ডিসমিসড।
পরের লোকটা কেন জানোয়ার মারে, জিজ্ঞেস করলে জানালো, তার কিছু ছাগল আছে। মেরে শেষ করে বুনো জানোয়ারে। ছাগল বাঁচাতেই জানোয়ার মারে সে।
কি জানোয়ার মারো?
এই গণ্ডার, জিরাফ, হাতি, জলহস্তী, জেব্রা, হরিণ…।
তাই নাকি? তাহলে আর কি শাস্তি দিই তোমাকে? নিজের ছাগল বাঁচাতে যেকেউই জানোয়ার মারবে, বলে ঘোষণা করলেন জজ। কেস ডিসমিসড।
কিশোরের গায়ে কনুই দিয়ে গুতো মারলো আফ্রিকান তরুণ। রাগে গজগজ করলো; যেসব জানোয়ারের নাম বললো, সব কটা ঘাস খায়, নাকের কাছে এসে বসে থাকলেও ছাগল মারবে না। পুরো ব্যাপারটাই প্রহসন।
ঝটকা দিয়ে ঘুরে বেরিয়ে গেল সে।
.
১২.
ছেলেরাও বিরক্ত হয়ে গেছে। তবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাতচল্লিশ জন পোচারের, হাস্যকর কৈফিয়ত আর জজের খোঁড়া যুক্তি শুনলো। বার বার কেস ডিসমিসড শুনতে ভালো লাগে না, এটা তিনিও বোঝেন, আর সে জন্যেই কয়েকজনকে শাস্তি দিলেন।
একজনকে জেল দেয়া হলো। না, দশ বছরের নয়, মোটে তিন দিন। রায় শুনে দাঁত বের করে হাসলো লোকটা। জেলে আরাম করে বিশ্রাম নিতে পারবে তিন দিন, আর ভালো খাবার পাবে, বাড়িতে ওরকম খাবার পায় না।
আরেকজনের তরমুজ খেত আছে জানালো। তাকে জরিমানা করা হলো। একটা তরমুজ।
অন্য একজনের আছে মুরগীর খামার। তাকে দিতে হবে দুটো ডিম, জরিমানা।
তবে বেশির ভাগই বেকসুর খালাস পেয়ে গেল।
জজের অলক্ষ্যেই আবার বিচার-কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো তিন গোয়েন্দা। রাগে, ক্ষোভে গম্ভীর হয়ে আছে তিনজনেই।
প্রাণের পরোয়া করলাম না, বাইরে বেরিয়েই ফেটে পড়লো রবিন। আর কিনা এভাবে ছেড়ে দিলো! ধরে এনে তাহলে লাভটা হলো কি?
ব্যাটা আরও ক্ষতি করে দিলো, মুসা সব চেয়ে বেশি রেগেছে। পোচার হারামজাদারা বুঝে গেল, ধরা পড়লেও কিচ্ছু হবে না। বেপরোয়া হয়ে উঠবে এখন ওরা আরও।
কিন্তু জজের ব্যাপারটা কি, বল তো কিশোর? রবিন বললো। এত বড় বড় কথা বলে এলো আমাদের কাছে, পোচারদের হেন করবে, তেন করবে। জন্তুজানোয়ারের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললো। সব কি তবে মিস্টার টমসনকে ধোঁকা দেয়ার জন্যে? আমার কথা বুঝতে পারছো? আমার বিশ্বাস, সিলভারের সঙ্গে যোগসাজশ আছে তার। লাভের বখরা।