কন্ট্রোলে নড়াচড়া করছে মুসার হাত। ঘাসের ওপর ভেসে উঠলো প্লেন।
তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে বড় বড় গাছগুলো। আড়াআড়ি বইছে বাতাস, ঠেলে নিয়ে যেতে চাইছে ডানে। প্লেনটা ছোট, ডানার দৈর্ঘ্য মাত্র উনচল্লিশ ফুট, অথচ এটার তুলনায়ও এয়ারস্ট্রিপটা সরু। প্লেন একটু এদিক ওদিক সরলেই বিপদ। লেগে যাবে গাছের সঙ্গে।
শেষ মুহূর্তে ঝটকা দিয়ে নাক অনেকখানি উঁচু করে ফেললো বিমান। উড়ে বেরিয়ে গেল গাছের মাথার সামান্য ওপর দিয়ে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো কিশোর বৈমানিক। আনমনেই হাসলো দাঁত বের করে। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো স্নায়ু।
গাছপালার ওপরে কিছুক্ষণ চক্কর দিয়ে বেড়ালো মুসা। শাঁ করে উড়ে গেল দুই বন্ধু আর ওয়ারডেনের মাথার ওপর দিয়ে। ওরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওপর দিকে। হাত নাড়লো সে।
হয়ে গেছে। ওড়াটা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। এবার নিরাপদে নামতে পারলেই, ব্যস। পরশু জানতো না স্টর্কের ব্রেক কোথায়, আজ জানে। গাছ পেরিয়ে এসে নাক নামিয়ে দিলো বিমানের। ঝরা পাতার মতো যেন ঝরে পড়তে লাগলো বিমানটা, অন্তত তার তা-ই মনে হলো। ঘাস ছুঁলো চাকা। ব্রেক চাপলো সে।
ঝাঁকুনি এড়াতে পারলো না। এই নিয়ে যতোবার ল্যাণ্ড করেছে সে, যতো প্লেন, কোনোটাই মসৃণ ভাবে নামতে পারেনি। তার মানে ওই কাজটাই বেশি কঠিন। দক্ষ পাইলটের বাহাদুরিই ওখানটায়।
ট্যাক্সিইং করে আগের জায়গায় এসে থামলো বিমান। বাবল খুলে বেরিয়ে এলো মুসা।
চমৎকার! প্রশংসা করলেন টমসন। সত্যি, খুব ভালো উড়তে পারবে তুমি।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।
মোমবাসায় যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে প্লেনে চড়লো তিন গোয়েন্দা। এবার আর বিমান ওড়াতে কোনো অসুবিধে হলো না মুসার। ছহাজার ফুট ওপর দিয়ে টিসাভো নদী বরাবর এগিয়ে চললো পুবমুখো।
টিসাভো রেল স্টেশন পেরিয়ে ডানে মোড় নিলো। ম্যাপ দেখে দেখে বলে দিচ্ছে কিশোর, কোন দিকে যেতে হবে। নিচে এক পাশে লাল সড়ক, আরেক পাশে রেল লাইন।
এই সেই জায়গা, জ্ঞানকোষের পাতা খুললো যেন রবিন। অনেক রক্ত লেগে আছে ওই রেললাইনে। অনেক বছর আগের কথা। খবরের কাগজের পাতা খুললেই নাকি তখন দেখা যেতো সেই রোমাঞ্চকর হেডলাইনঃ আবার আঘাত হেনেছে টিসাভোর মানুষখেকো! ভয়ানক কতগুলো সিংহ মানুষখেকো হয়ে উঠেছিলো, রোজই ধরে নিয়ে যেতে রেললাইনের শ্রমিকদের। ওগুলোর যন্ত্রণায় রাতে ঘরেও থাকতে পারতো না শ্রমিকরা। বেড়া ভেঙে ঢুকে ধরে নিয়ে যেতো ভয়াবহ সিংহের দল। শেষে…
বাঁয়ে গ্যালানা নদীর চকচকে রূপালী রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল রবিন। চোখ। বড় বড় করে দেখছে। সবুজ চাঁদরের ওপর অবহেলায় আঁকাবাঁকা হয়ে পড়ে থাকা একটা ফিতে যেন। সেই ভারত মহাসাগরে গিয়ে পড়েছে নদীটা, জানে সে। উত্তরে শত শত মাইল জুড়ে বিছিয়ে রয়েছে টিসাভো পার্কের বুনো প্রান্তর, মাঝে মাঝে ঠেলে উঠেছে লাল পাহাড়।
চোখে পড়লো লুগার্ডস ফল। জলপ্রপাতের নিচে যেন টগবগ করে ফুটছে পানি, পুরু হয়ে জমেছে সাদা ফেনা, অপরূপ লাগছে সকালের আলোয়। প্রপাতের পানি জমে এক জায়গায় একটা পুকুরমতো সৃষ্টি হয়েছে, তার পাড়ে ভিড় করেছে। হাতি, গণ্ডার, জিরাফ। আশপাশে ছোট ছোট আরও অনেক ডোবা আছে, ওগুলোর পাড়ে নানারকম জন্তুজানোয়ারের ভিড়, পানি খেতে এসেছে। পাশের সবুজ তৃণভূমিতে চরছে মোষ, জেব্রা আর ওয়াইল্ডবীস্টের দল। ঝোপের কিনারে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখা গেল একটা সিংহ পরিবারকে, শিকার ধরবে বোঝা যাচ্ছে। চিতাবাঘ একটাও চোখে পড়লো না। নিশাচর জীব ওরা, রাতে বেরিয়ে শিকার করে, দিনে ঘুমিয়ে থাকে পাহাড়ের গুহায়, কিংবা গভীর বনের অন্ধকারে।
এক গুচ্ছ গাছের ভেতর থেকে হালকা ধোয়া উঠতে দেখা গেল।
পোচারদের ক্যাম্প? কিশোর বললো।
দেখো দেখো, ওই যে ট্র্যাপ-লাইন! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। বেড়া বানিয়ে ফাঁদ পেতেছে পোচাররা, সেদিকে তাকিয়ে আছে সে। খাইছে। পাঁচ মাইলের কম হবে না।
জোরে জোরে হিসেব শুরু করলো কিশোর, তারমানে ছাব্বিশ হাজার ফুট। প্রতি পাঁচ ফুট পর পর যদি একটা করে ফাঁদ পাতা হয়, তাহলে কম করে হলেও পাঁচশো ফাঁদ। এর অর্ধেক ফাঁদেও যদি জানোয়ার ধরা পড়ে…সর্বনাশ…! থেমে গেল সে।
অর্ধেক হবে কেন? রবিন বললো। কাল যেটা নষ্ট করলাম আমরা, কোনো ফাঁকই বাদ ছিলো না। প্রত্যেকটাতে জানোয়ার পড়েছিলো। প্রতি হপ্তায় একবার করে ফাঁদ পরিষ্কার করে নতুন করে পাতে ব্যাটারা। তারমানে মাসে দুহাজার! মাহ, আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা!
আর মনে রেখো, কিশোর বললো। বেড়া এই একটা নয়। এর চেয়ে অনেক বড় বড় ফাঁদ পাতা রয়েছে পূর্ব আফ্রিকার নানান জায়গায়…ওয়ারডেন কি বললেন, শোনোনি?
সহজ পথ। ম্যাপ দেখার প্রয়োজনই পড়ছে না। রেলপথ, সড়কপথ দুটোই গেছে মোমবাসায়। ওগুলো ধরে উড়লেই হলো।
অবশেষে সাগর চোখে পড়লো। ভারত মহাসাগরের মাঝে যেন মূল্যবান ঝকঝকে পাথরের মতো ফুটে রয়েছে প্রবাল দীপগুলো, সব চেয়ে বড়টার নাম মোমবাসা।
শহরের আট মাইল দূরে এয়ারফীল্ড। প্লেন থেকে নেমে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করলো তিন গোয়েন্দা। টমসনের চিঠি দেখালো।
এয়ারফীল্ড থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে আদালতে রওনা হলো ওরা।
কি জানি কি মনে হলো, বিচারকক্ষে ঢোকার আগে ডাবলডোরের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকালো কিশোর।