খাচ্ছে না কিশোর, বসে বসে ভাবছে। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে কফি। মুসা আর। রবিনের সঙ্গে এতোক্ষণ কথা বলেছেন তিনি, তাদের আলোচনায় যোগ দেয়নি সে।
মুখ তুলে হাসলো কিশোর। অ্যাঁ?
বলবে আমাকে?
দ্বিধা করলো কিশোর। ইয়ে…আপনার বন্ধু…জজ নির্মল পাণ্ডা। খুব বিশ্বাস করেন তাকে, না?
করি, স্বীকার করলেন টমসন। যখন-তখন অযাচিত ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার অনেক উপকার করেছে। এই তো, গত পরশুই তো আমার প্রাণ বাঁচালো। তোমরা দেখেছো।
উনি…, বলতে গিয়ে কিশোরের চোখের দিকে চেয়ে থেমে গেল রবিন। আরেকটু হলেই বলে ফেলেছিলো বাঁচাননি, বরং আমরা না থাকলে খুন। করতেন।
আর, একটা ব্যাপারে আমাদের খুব মিল, বলে চললেন ওয়ারডেন। পোচার। আমিও ওদের দেখতে পারি না, সে-ও পারে না। ওকে না পেলে যে কি করতাম…আমি ওদেরকে ধরতে পারি, কিন্তু শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। শাস্তি দেয় নির্মল। সে ওদেরকে ফাইন করে, জেলে পাঠায়। পোচিঙের বিরুদ্ধে আইন খুব কড়া। কঠিন শাস্তি হয়, অনেক দিন জেল।
শাস্তি দেন তো ঠিকমতো?
বলে তো দেয়। আর বলে যখন, নিশ্চয়ই দেয়।
বিচারের সময় কখনও কোর্টে ছিলেন?
না, এতো বেশি ব্যস্ত থাকি, যেতে পারিনি। তবে আমার যাওয়ার দরকার নেই। আমার কাজ আমি করি, ওর কাজ ও।
ডিম ভাজার প্লেটটা টেনে নিলো কিশোর। নীরবে খেলো কয়েক মিনিট। হঠাৎ বললো, ভেরি ইনটারেস্টিং! জজ সাহেবের কথা বলছি, ভারি মজার মানুষ। তার কাজ দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। আজ অনেক লোকের বিচার করবেন। গিয়ে দেখতে পারবো?
আমি যেতে পারবো না, মাথা নাড়লেন টমসন। তবে ইচ্ছে করলে তোমরা যেতে পারো। কিন্তু যাবে কিভাবে? যেতে-আসতে প্রায় আড়াইশো মাইল, পথও খুব খারাপ। এখানে আমি ছাড়া এখন আর কেউ নেই যে গাড়ি চালাতে-জানে, নিয়ে যাবে, তোমাদেরকে।…একটা কাজ করলে অবশ্য পারো। মুসা বেশ ভালো। পাইলট, সেদিন স্টর্কটাকে যেভাবে সামলেছে শুনলাম। প্লেন নিয়ে যেতে পারো। বসো, আসছি।
ডেস্ক থেকে একটা ম্যাপ বের করে নিয়ে এলেন তিনি। এই যে মোমবাসা..আর এই এখানে আমাদের লজ। জানো নিশ্চয়, শহরটা গড়ে উঠেছে। একটা দ্বীপের ওপর। মেন ল্যাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে কজওয়ের সাহায্যে। এই এখানটায় হলো ল্যাণ্ডিংফীল্ড, পেন্সিল দিয়ে একটা গোল দাগ দিলেন টমসন। প্লেন রেখে ট্যাক্সি নিয়ে আদালতে চলে যেও এই এখানটায়। আদালত, আরেকটা চিহ্ন আঁকলেন তিনি।
লাইসেন্স লাগবে না? রবিন জিজ্ঞেস করলো। মুসার তো প্লেন চালানোর লাইসেন্স নেই।
বলে দেবো শিক্ষানবীস। একটা চিঠি লিখে দেবো, এয়ারপোর্টের ম্যানেজারকে দেখিও, অসুবিধে হবে না, মুসার দিকে ফিরলেন ওয়ারডেন। চলো, আরও প্র্যাকটিস করে নাও।
এয়ারস্ট্রিপে এসে প্রথমে বিমানটায় তেল ভরলেন তিনি। দুই ডানার ট্যাঙ্ক তো বোঝাই করলেনই, পেছনের ইমারজেন্সি ট্যাঙ্কও ভরে দিলেন। বিমানের ভেতরের একটা হ্যাঁণ্ডপাম্প দেখালেন তিন গোয়েন্দাকে, প্রয়োজন হলে ওই পাম্পের সাহায্যে পেছনের ট্যাঙ্ক থেকে ডানায় তেল সরিয়ে আনা যায়।
ককপিটের যন্ত্রপাতিতে লেখা জার্মান শব্দগুলো পড়ে পড়ে বুঝিয়ে দিলেন। কোনটা কোন যন্ত্র, কিভাবে কাজ করে।
যাও, উড়ে এসো খানিকক্ষণ, মুসাকে বললেন তিনি। ওঠা আর নামাটাই আসল, ভালোমতো প্র্যাকটিস দরকার।
পাইলটের সীটে উঠে বসলো মুসা,। রবিন আর কিশোরকে মানা করলো, তোমরা এখন না। আগে আমি দেখে আসি উড়ে। কেন, আমাদের নিয়ে পোচার প্র্যাকটিস হবে না? রবিন বললো।
হবে, ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসলো মুসা। তবে, অ্যাক্সিডেন্ট করে মরলে আমি বরং একাই মরি। তিনজন একসাথে মরে লাভ কি? কি বলো, কিশোর মিয়া? তুমি যেমন একা বুদ্ধির প্র্যাকটিস করো, আমিও এখন ফ্লাইং প্র্যাকটিস করি, নাকি?
সুযোগ পেয়ে খুব একহাত নিচ্ছে তাকে মুসা, বুঝে মুখ গোমড়া করে সরে এলো কিশোর। রবিন তর্ক করতে লাগলো।
মুসা ঠিকই বলেছে, পক্ষ নিলেন ওয়ারডেন। মরবে না ও, হাসলেন তিনি। অপরিচিত একটা মেশিনকে যেভাবে সামলেছে, শুনে অবাকই লেগেছে আমার। একেবারে জাত-বৈমানিক। ভবিষ্যতে ভালো পাইলট হবে…।
তাহলে আর আমাদের যেতে অসুবিধে কি? ফস করে বললো রবিন।
তবু, তার কথা কানে তুললেন না টমসন। ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। অ্যাক্সিডেন্টের কথা কিছু বলা যায় না, কিশোর আর রবিনের দিকে চেয়ে আবার হাসলেন। একজন জাত-বৈমানিকের সঙ্গে সঙ্গে হাত-পা ভেঙে অকেজো হয়ে থাকুক একজন জাত-গোয়েন্দা আর একজন জাত-গবেষক, তা-ও চাই না।
হাসি ফুটলো গোয়েন্দাপ্রধান আর নথি-গবেষকের মুখে।
তাহলে আসি, হাত তুলে বিদায়ী ভঙ্গিতে সালাম জানালো মুসা, করুণ করে। তোলার চেষ্টা করলো মুখটাকে। কিন্তু অভিনেতা নয় সে, হাসি ঢাকতে পারলো না। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসবো। যদি ভুলভাল বোতাম টিপে না বসি।
উইণ্ড-সকের দিকে তাকালো সে। সামনের বড় বড় গাছগুলোর দিকে চেয়ে। দমে গেল। সময় মতো উড়াল দিতে পারবে ওগুলোর মাথার ওপর দিয়ে! পারবে, পারবে, নিজেকে বোঝালো সে। মন শক্ত করে স্টার্ট দিলো এঞ্জিন। বুস্টার পাম্প পরীক্ষা করে দেখলো। তারপর অপেক্ষা করতে লাগলো অয়েল টেম্পারেচার বাড়ার জন্যে।
থ্রটল দিতেই ট্যাক্সিইং করে চললো প্লেন। গতি বাড়তে চাইছে না। দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে মুসা, যেন তাতেই শক্তি পাবে এঞ্জিন। আফসোস করছে, ইস, ঘাসের না হয়ে যদি অ্যাসফল্টে বাঁধানো হতো স্ট্রিপটা! দুলছে প্লেন, ঝাঁকুনি খাচ্ছে, তবে গতি বাড়ছে দ্রুত।