গুড, বললো মুগামবি। আঙুলগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা চেপে রয়েছে…বুট…যা সিমবা, এগো।
চেয়ে রয়েছে…বুট বলে কি বোঝালো? জিজ্ঞেস করলো মুসা।
বুটের জন্যে ওরকম হয়েছে বললো, হাঁটতে হাঁটতে জবাব দিলেন টমসন। সব সময় কেউ শক্ত বুট পরে থাকলে পায়ের আঙুল পাশাপাশি চেপে মাঝের ফাঁক কমে যায়। আর যারা সব সময় খালি পায়ে হাঁটে তাদের আঙুল ছড়িয়ে যায়, বড় হয়ে যায় ফাঁক।
কিছু দূর গিয়ে আবার নতুন কায়দা করেছে সিলভার। মোড় নিয়ে এগিয়ে সোজা নেমে গেছে টিসাভো নদীতে।
হতাশ হয়ে গর্জে উঠলো সিমবা। অ্যালসেশিয়ানের ডাকের সঙ্গে মিল নেই, একেবারে বুনো কুকুরের চিৎকার। আফ্রিকার তৃণভূমিতে, জঙ্গলে ওই ডাক অহরহ শোনা যায়।
আর হবে না, মুগামবিও হাল ছেড়ে দিলো। সরাসরি ওপারে গিয়ে নিশ্চয় ওঠেনি। হয় উজানে গেছে, নয়ত ভাটিতে। সাঁতরে ভাটিতে যাওয়ারই বেশি সুবিধে। অনেক দূর গিয়ে ওপারে কোনো ঝোপের ভেতর দিয়ে উঠে গেছে। হাজার খুঁজলেও পাওয়া যাবে না আর। আমি শিওর, ঘাসের ওপর উঠেছে সে। আর যা গরম। ঘাসের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে গেছে পানি। ব্যাটা গেছে। অনেকক্ষণ হয়েছে। আমরা যেতে যেতে ছাপের কোনো চিহ্নই থাকবে না।
.
১০.
সাতচল্লিশ জন. ঘুমন্ত পোচারকে মরা মাছের মতো গাদাগাদি করে ভরা হলো। হাতির খাঁচার মধ্যে। অন্তত আরও ঘন্টা চারেক ঘুমিয়ে থাকবে ওরা, একশো তিরিশ মাইল পেরিয়ে মোমবাসা যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট সময়। ওখানে জেলখানায় ঘুম ভাঙবে ওদের।
জেল-ওয়ারডেনের কাছে একটা নোট লিখে দিলেন টমসনঃ পোচিঙের অপরাধে সাতচল্লিশ জন পোচারকে ধরে পাঠালাম, বিচারের জন্যে। একজন রেঞ্জারের হাতে নোটটা দিয়ে ওয়াগনের সঙ্গে যেতে বললেন।
অন্যদের থাকতে হবে, অনেক কাজ পড়ে আছে। শখানেকের বেশি। জানোয়ার আটকা পড়ে আছে ফাঁদে, যেগুলো এখনও মরেনি, ছাড়াতে হবে।
মরা কিংবা মুমূর্ষ জানোয়ারগুলোকে মাছির মতো হেঁকে ধরেছে শকুনের দল। মানুষ কাছে যেতেই উড়ে গেল। হায়েনা আর শেয়ালের পালও সরে গেল, একেবারে গেল না অবশ্য, মানুষ চলে গেলেই আবার আসবে।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করছে কিছু কিছু জানোয়ার। তাতে গলায় আরও চেপে বসছে তারের ফাঁস, ধারালো ছুরির মতো চামড়া কেটে ঢুকে যাচ্ছে মাংসের গভীরে। রক্ত ঝরছে। এভাবে বেশিক্ষণ টানাটানি করতে থাকলে আপনা-আপনি। জবাই হয়ে যাবে।
বাঁচার সম্ভাবনা আছে এমন কিছু জীবকে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ফাঁস-মুক্ত করলো মাসাইরা। যেগুলোর জখম কম, ছাড়া পেয়েই ছুটে পালালো। বেশি জখমিগুলোকে লরিতে তুলে নেয়া হলো, হাসপাতালে নিয়ে যাবে।
প্রতিটি ফাঁস কেটে দেয়া হলো, নষ্ট করা হলো মাটিতে পেতে রাখা ফাঁদ।
কুঁড়েগুলোর কি হবে? কিশোর জিজ্ঞেস.করলো।
বেড়া, কুঁড়ে, সব পুড়িয়ে দেবো, বললেন ওয়ারডেন। এ আগুন লাগানো হলো বেড়ায়। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো এক মাইল লম্বা শুকনো কাঁটালতা। জিনিসপত্র সব বের করে এরপর কুঁড়েগুলোতেও আগুন, লাগানো হলো। মনে হচ্ছে যেন দাবানল লেগেছে।
জিনিসগুলো আলাদা আলাদা জায়গায় জড়ো করা হয়েছে।
জীবনে দেখিনি এরকম কাণ্ড! আনমনে বিড়বিড় করতে করতে মাথা নাড়লো। রবিন। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে প্রায় তিনশো হাতির পায়ের দিকে। ফুটখানেক ওপর থেকে কেটে নেয়া হয়েছে, মাঝের হাড়মাংস সব ফেলে দিয়ে ওয়েইস্ট-পেপার বাস্কেট বানানো হবে।
আরেক জায়গায় স্তূপ করে রাখা হয়েছে অসংখ্য চিতাবাঘের মাথা। প্রতিটি মাথা কয়েক হাজার ডলারে বিকোবে। ইউরোপ-আমেরিকা থেকে সাফারিতে আসে। লোকে। তাদের মাঝে অনেক ধনী মানুষ থাকে, যার চিতাবাঘ শিকার করে মাথা। নিয়ে গিয়ে নিজের বাড়ির ড্রইংরুমে সাজাতে চায়। চিতাবাঘ নিশাচর জীব, অসাধারণ ধূর্ত, দক্ষ শিকারীর পক্ষেও শিকার করা কঠিন। আনাড়ি টুরিস্ট সেটা পারে না। কয়েক রাত গাছের ডালে কিংবা মাচায় কাটিয়েই বিরক্ত হয়ে যায়। শেষে সহজ কাজটাই করে। সোজা গিয়ে নাইরোবি থেকে একটা মাথা কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরে, হয়তো বাহাদুরি দেখিয়ে বলে আমি মেরেছি। কে দেখতে আসছে, সে সত্যি কথা বলছে না মিথ্যে?
চিতাবাঘের মাথার পাশে জমানো হয়েছে চিতার চামড়া। সোফার কাভার হবে হয়তো ওগুলো দিয়ে, কিংবা ডিভানের পায়ের কাছের কার্পেট। শান্ত, ন্দ্র, মিষ্টি যে মহিলাটি ঘর সাজাবেন ওগুলো দিয়ে, এয়ারগান দিয়ে শিকার করা চড়ুই পাখি ছেলের হাতে দেখলে শিউরে ওঠেন যিনি, মুহূর্তের জন্যেও ভাববেন না, শুধু তাঁর ড্রইংরুমের শোভা বাড়ানোর জন্যেই অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে কতগুলো অপূর্ব সুন্দর জানোয়ারকে।
ওগুলো কি? কয়েকটা কাঠের পাত্রে রাখা অদ্ভুত কিছু বাঁকা বাঁকা চুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা।
মনে হয় হাতির চোখের পাপড়ি, জবাব দিলো রবিন।
দূর, কি বলো? ওসব দিয়ে কি করবে?
করবে বলেই তো নিয়েছে।
কি হয়?
আসলে হয়তো হয় না কিছুই, সুযোগ পেয়ে বিদ্যে ঝাড়তে শুরু করলো। বইয়ের পোকা শ্রীমান রবিন মিলফোর্ড, ওরফে চলমান জ্ঞানকোষ। সব কুসংস্কার। কিন্তু সিঙ্গাপুরে এর দারুণ চাহিদা। কুসংস্কারে বিশ্বাসী লোকেরা মনে করে, যার কাছে যতোটা হাতির চোখে পাপড়ি থাকবে, সে ততোটা ছেলেপুলের বাপ হবে। নানারকম অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীও নাকি ওই চুল। বইয়ে পড়েছি, একজন পিগমী রাজা নাকি বায়ান্ন শো পাউণ্ড দামের হাতির দাঁত দিয়ে ফেলেছিলো শুধু একটি মাত্র পাপড়ি জোগাড়ের জন্যে। অ্যারাবিয়ানদের অনেকের কাছেও এর যথেষ্ট কদর। তাদের বিশ্বাস, ওই পাপড়ি দিয়ে মালা বানিয়ে গলায় ঝোলালে রাইফেলের গুলি লাগে না শরীরে, কাছে এসেও পাশ কাটিয়ে আরেক দিকে চলে যায়।