কি ভাবছো বুঝতে পারছি, হেসে বললেন ওয়ারডেন। রেঞ্জাররা ওই খুটি টেনে তুললো না কেন, এই তো? তাহলে ফাঁদ নিয়েই খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে গাড়িতে উঠতে পারতো। তোমার তো দুটো পা-ই ভালো। যাও, দেখো ওপড়াতে পারো কিনা।
টানতে টানতে নীল হয়ে গেল কিশোরের মুখ। তার সঙ্গে গিয়ে মুসাও হাত লাগালো। দুজনে মিলে টেনেও নাড়তে পারলো না গজালটা। পোঁতা হয়েছে উইয়ের ঢিবিতে। গোলমাল শুনে বিরক্ত হয়েই যেন কি হচ্ছে দেখতে বেরোলো উইয়েরা।
পারবে না, মাথা নাড়লেন টমসন। খামোকা কষ্ট করছে। তিন ফুট লম্বা একেকটা। বড় হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বসানো হয়েছে। উইয়ের ঢিবিগুলো দেখতে দেখা যাচ্ছে মাটি, আসলে সিমেন্টের মতো শক্ত। হাতির পায়ে শেকল বেঁধে দিয়ে দেখো, তারও টেনে তুলতে কষ্ট হবে। আর ফাঁদে আটকা থাকলে তো পারেই না, ভীষণ ব্যথা লাগে পায়ে। যাও, সাপ্লাই ভ্যান থেকে শাবল নিয়ে এসো। চাড় মেরে খুলতে হবে।
গিয়ে শাবল আনলো মুসা।
দাঁতের ফাঁকে শাবল ঢুকিয়ে চাড় দিয়ে চোয়াল দুটো ফাঁক করলেন টমসন। বেচারা লোকটার রক্তাক্ত পা-টা বের করে আনা হলো। মাংস কেটে হাড়ে গিয়ে বসেছিলো দাঁত। তাড়াতাড়ি অ্যানটিসেপটিক আর ব্যাণ্ডেজ এনে, ক্ষত পরিষ্কার করে বেঁধে দিতে লাগলো কিশোর।
.
০৯.
আরি! বেড়ার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। দাড়িওয়ালা কোথায়?,
প্রচণ্ড উত্তেজনায় সিলভারের কথা ভুলে গিয়েছিলো সবাই।
হাঁটু গেড়ে বসে কিশোরের ব্যাণ্ডেজ বাঁধা দেখছিলো মুসা, লাফ দিয়ে উঠে। দাঁড়ালো। চেঁচিয়ে ডাকলো, মুগামবি, কালিমবো, জলদি এসো। সিমবাকে নিয়ে এসো।
আগে আগে ছুটলো ট্র্যাকার মুগামবি, লম্বা ঘাস এড়িয়ে থাকছে যতোটা সম্ভব, যাতে ফাঁদে পা না পড়ে। তার পেছনে রইলো অন্যেরা।
বেড়ার একটা ফাঁক দিয়ে আরেক পাশে চলে এলো। কেউ নেই।
কুঁড়েগুলোতে দেখো, বলেই একটা কুঁড়ের দিকে দৌড় দিলো মুসা।
সব কটা কুঁড়েতে খুঁজে এলো সে আর কালিমবো। ফিরে এসে দেখলো, এক জায়গায় মাটিতে ঝুঁকে কি যেন দেখছে মুগামবি।
মাটিতে পায়ের ছাপের ছড়াছড়ি, পোচারদের নগ্ন পা। পাঁচটা করে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। ওগুলোর মাঝে এক সারি ছাপ আছে, যেগুলোর আঙুল নেই।
বুট, মুগামবি বললো। দাড়িওয়ালাটা। বুট পরেছিলো। ধরে ফেলা যাবে।
বুটের ছাপ অনুসরণ করে চললো ট্র্যাকার। বারো-তেরো কদম এগিয়েই দাঁড়িয়ে গেল। চোখে বিস্ময়। ছাপ নেই আর। আচমকা যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে বুটধারী। গাছে চড়লো নাকি?
ওপরে তাকালো মুগামবি। নেই। একটা নিচু ডালও নেই, যেটাতে উঠতে পারবে বুট পরা লোকটা।
মহা শয়তান, বাতাসে থাবা মারলো মুগামবি। বুট খুলে নিয়েছে। কেউ যাতে পিছু নিতে না পারে।
এখানেও পায়ের ছাপ অনেক আছে, বুট পরা একটাও নেই, সব নগ্ন। সিলভারের ছাপ কোনটা এখন আর বোঝার উপায় নেই।
সিমবা! তুড়ি বাজালো মুসা। কুকুরটাকে দিয়ে চেষ্টা করালে কেমন হয়?
ডেকে সিমবাকে সেই জায়গাটায় নিয়ে গেল কালিমবো, বুটের ছাপ যেখান থেকে শুরু হয়েছে। শুকতে বললো। কথা বুঝলো বুদ্ধিমান কুকুরটা। নাক নিচু করে বুটের ছাপ শুকলো কয়েকবার, ওপরে মাথা তুলে গন্ধ নিলো বাতাসে। ছাপ অনুসরণ করে চলে এলো যেখানে বুটের চিহ্ন শেষ হয়েছে। থেমে ওপরের দিকে নাক তুলে আবার গন্ধ শুকলো। মৃদু ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা থেকে।
টমসনও এসে দাঁড়িয়েছেন। বললেন, কুকুরটা চালাক বটে। কিন্তু বুট আর। খালি পায়ের ছাপ আলাদা করে চিনতে পারবে না।
দেখুন না কি করে? হেসে বললো কালিমবো।
ফিরে গিয়ে আবার শুরুর জায়গায় বুটের ছাপ শুকলো সিমবা। তারপর আশপাশের অন্য ছাপগুলো.। আশা-নিরাশায় দুলছে মুসার মন। সবই নির্ভর করছে এখন ছাপগুলো নতুন না পুরনো তার ওপর। নতুন হলে চামড়ার গন্ধে ঢাকা পড়ে যাবে লোকটার ঘামের গন্ধ। কিন্তু যদি পুরনো হয়, এই গরমে ঘামে ভিজে গন্ধ হয়ে যাবে জুতোর চামড়া, তীব্র সেই গন্ধ কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারবে না কুকুরের প্রখর ঘ্রাণশক্তিকে।
হলোও তাই। খেঁকিয়ে উঠলো সিমবা। আবার নাক নামিয়ে বুটের ছাপ। শুকলো। তারপর জোরে ঘেউ করে উঠে দৌড়ে এলো বুটের ছাপ যেখানে শেষ হয়েছে তার কাছে। কয়েকটা নগ্ন পায়ের ছাপ শুকলো। একটার কাছে এসে আরেকবার চেঁচিয়ে উঠে দিলো দৌড়। কয়েক পা গিয়ে আবার শুকলো। চললো আবার।
পেয়েছে! বাচ্চা ছেলের মতো হাততালি দিয়ে উঠলো মুসা। পেয়ে গেছে। সে-ও ছুটলো কুকুরটার পেছনে।
কিন্তু লোকটা বোকা নয়। মাসাইদের সঙ্গে কুকুর আছে, নিশ্চয় দেখেছে। কিছু দূর গিয়ে আরেক ফন্দি করেছে ধোকা দেয়ার জন্যে। নিজের রক্তের ওপর পড়ে রয়েছে একটা মরা মোষ। সোজা গিয়ে সেই রক্তে পা ভিজিয়েছে সিলভার। পচা রক্তের গন্ধে ঢাকতে চেয়েছে নিজের গায়ের গন্ধ। মোষটার চারপাশে ঘুরেছে কয়েকবার, যততক্ষণ না পা থেকে রক্ত মুছে গেছে, বালি লেগেছে পায়ে। তারপর অন্য আরও অনেক চাপের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলে গেছে। এখন বের করবে কি করে সিমবা?
নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ওয়ারডেন।
কিন্তু কালিমবোর বিশ্বাস আছে তার কুকুরের ওপর?
ছাপ চিনতে বেশ দেরি হলো সিমবার। বিচিত্র ভঙ্গিতে মাথা ঝাড়ছে, যেন শিওর নয় সে।
তবে এখন তাকে সাহায্য করতে পারলো আরেক ওস্তাদ। পিছিয়ে গিয়ে সিলভারের খালি পায়ের ছাপ ভালো মতো দেখলো মুগামবি। মাপ নিলো। এগিয়ে এসে রক্তে ভেজা ছাপ মাপলো। বেরিয়ে যাওয়া ছাপগুলো থেকে ঠিক বের করে ফেললো, কোনটা দাড়িওয়ালার ছাপ। সিমবা যে জোড়া বেছে নিয়েছে, ওগুলোই।