ওই পালের গোদাটাকে ধরতে না পারলে হাজার পোঠর ধরেও লাভ হবে না, আবার বললেন টমসন। এক জায়গা থেকে তাড়ালে আরেক জায়গায় গিয়ে। পোচিং শুরু করবে।
হুঁ! মাতা দোলালো কিশোর।
আরও কয়েক মিনিট চলার পর গাড়ি থামাতে বললো সে। রবিন আর মুসাকে নিয়ে নেমে গিয়ে উঠলো সাপ্লাই ভ্যানে। আবার চললো মিছিল।
ক্যাম্প থেকে কয়েক ডজন ডার্ট নিয়ে আসা হয়েছে, ওগুলোতে ওষুধ ভরতে হবে। ডার্টগুলো দেখে মনেই হয় না, হাতিকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে নিমেষে। আট ইঞ্চি লম্বা, কড়ে আঙুলের মতো মোটা। এক মাথায় ইঞ্জেকশনের সুচের মতো, সুচ, তবে আরও খাটো। আরেক মাথায় হালকা এক গুচ্ছ পালক বাধা, ভারসাম্য বজায় রেখে যাতে নিশানা মতো গিয়ে আঘাত হানতে পারে ডার্ট সেজন্যে।
বার বার এপাশে ওপাশে মোড় নিচ্ছে গাড়ি, ভীষণ ঝাঁকুনি। জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখলো কিশোর। পথ ছেড়ে বিপথে নেমেছে ভ্যান, কিংবা বলা ভালো উঠেছে। চাকার নিচে ছোট ছোট টিলা-টক্কর। আশেপাশের কোনো কোনোটা বেশ বড়,পনেরো-বিশ ফুট উঁচু। উইয়ের ঢিবি। ছোটগুলোর ওপর দিয়ে চলেছে গাড়ি, বড়গুলোর পাশ কাটাচ্ছে।
ঢিবিগুলো পেরিয়ে এসে গাড়ি থামলো। সামনে পাঁচশো গজ মতো দূরে পোচারদের বেড়া। বেড়া থেকে দূরে গাড়ি থামানোর কারণ আছে। পোচাররা থাকলে তীর ছুঁড়তে পারে। বেশি কাছে গেলে গায়ে লাগবে তীর, ঝুঁকি নেয়ার। মানে হয় না। তাই দূরেই রেখেছেন ওয়ারডেন।
এসো, জলদি হাত লাগাও, দুই সহকারীকে বললো গোয়েন্দপ্রধান। প্রাস্টিকের ব্যাগ খুলে ভ্যানের মেঝেতে ঢাললো ডার্টগুলো। বড় একটা শিশি বের করলো, তার মধ্যে পানির মতো পাতলা সাদাটে ওষুধ।
জিনিসটা কি? মুসা জিজ্ঞেস করলো। অ্যাকোর রঙ তো কালো—
এটা সেরনিল, মাসকিউলার অ্যানাসথেটিক। জানোয়ার ধরার জন্যে ব্যবহার হয়। রক্তে ঢুকলেই ঘুমিয়ে যায়।
দ্রুত ডার্টে ওষুধ ভরে নিতে লাগলো ওরা। ভরা শেষ করে তিনটে চামড়ার বাকেটে ডাটগুলো নিয়ে, নামলো ভ্যান থেকে। চলে এলো ল্যাণ্ড-রোভারের পাশে।
পোচারদের দেখা নেই। বেড়ার ওপাশে ওদের কুঁড়েগুলো আছে। আর আছে। বেড়ার ফাঁকে ফাঁদে আটকা পড়া অসহায় জানোয়ারের দল। যন্ত্রণা আর আতঙ্কে চিৎকার করছে।
মাসাইরা সবাই নেমে এসেছে। তাদের মাঝে ডার্ট বিলি করে দিলেন ওয়ারডেন আর তিন গোয়েন্দা। বেড়ার দিকে মুখ করে পাশাপাশি এক সারিতে রাখা হয়েছে গাড়িগুলো। ওগুলোর সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়ালো ঘুম-যোদ্ধারা। ডার্ট ছোঁড়ার জন্যে নিশপিশ করছে হাত। কিন্তু শত্রু কই? অধৈর্য হয়ে আগে বাড়লো কয়েকজন মাসাই।
এই, থামো! চেঁচিয়ে বললেন ওয়ারডেন। কোথায় যাচ্ছো? পিছাও।
আরে, দেখো দেখো, হাত তুললো মুসা। এহহে, সরে গেল! বেড়ার ফাঁক দিয়ে মাথা বের করেছিলো। কালো চাপদাড়ি।
কাউকে দেখলো না রবিন। কিশোরও না। সিলভার না তো?–ভাবলো সে। মুসা যখন বলছে দেখেছে, নিশ্চয় দেখেছে। তার কান আর চোখের ওপর পুরোপুরি। ভরসা করা যায়।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠেছে সবাই, কিন্তু কাউকে এগোতে দিলেন না ওয়ারডেন। কে জানে বেড়ার ওপাশে ঘাপটি মেরে আছে কিনা পোচাররা।
হঠাৎ তারস্বরে ঘেউ ঘেউ শুরু করলো সিমবা। ঝাড়া দিয়ে কালিমবোর হাত থেকে গলার বেল্ট ছাড়িয়ে ছুটে যাওয়ার জন্যে জোরাজুরি করতে লাগলো। ফাঁদে পড়ার ভয় আছে, ছাড়লো না তাকে তার মালিক।
অবশেষে, এক ফাঁকে দেখা দিলো একটা কালো মাথা। আরেক ফাঁকে আরেকটা। তারপর আরেকটা।
ব্যাটারা দেখছিলো আমাদের, রবিন বললো। বোঝার চেষ্টা করছিলো আমারদের উদ্দেশ্য।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। নিরাপদ বুঝে এখন বেরিয়ে এসেছে।
ঠিকই বলেছে দুজনে। লুকিয়ে থেকে দেখছিলো পোচাররা। রাইফেল নেই। দেখে সাহস পেয়ে বেরিয়ে এসেছে এখন। মুমূর্ষ জানোয়ারগুলোর আশপাশ দিয়ে পা টিপে টিপে বেরোলো ওরা। হাতে তীর-ধনুক, পিঠে বাঁধা বল্লম। ফলায় বিষ মাখানো, সন্দেহ নেই। বেড়ার এপাশে, এসে সারি দিয়ে দাঁড়ালো ওরাও। জনা পঞ্চাশের কম না।
এমনভাবে চেয়ে আছে পোচাররা, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। গাধা। নাকি! ক্যাম্প থেকে এসেছে শত্রু এলাকায়, অথচ সঙ্গে রাইফেল-বন্দুক কিচ্ছু নেই, শুধু ছোট ছোট কয়েকটা লাঠির মতো জিনিস। উপজাতীয় আধা-জঙলী ওরা, এ ধরনের আধুনিক ডার্টগান দেখেনি জীবনে, অস্ত্রগুলোর মাহাত্ম জানে না। একজন তো হেসেই ফেললো। ব্যস, সংক্রামিত হয়ে গেল হাসিটা। হাসতে শুরু করলো সবাই। আর সে-কি হাসি! হাসতে হাসতে বাঁকা হয়ে গেল সবাই, উরুতে চাপড় মারছে ঠাস ঠাস করে। শেষে উলুকের মতো নাচতে আরম্ভ করলো। তীর ছুঁড়লো। কয়েকজন। পাঁচশো গজ অনেক দূর, নিশানায় পৌঁছার বহু আগেই মাটিতে পড়ে গেল সেগুলো।
তীর-ধনুক আর বল্লম তুলে, শরীর সামান্য কুঁজো করে, এক পা এক পা করে এগোতে শুরু করলো পোচাররা। দেখে দেখে সাবধানে পা ফেলছে। নইলে নিজেদের পাতা ফাঁদে নিজেরাই আটকাবে। লম্বা ঘাসের ভেতরে পেতে রাখা হয়েছে ওসব ফাঁদ।
রেডি থাকো, বললেন ওয়ারডেন। আমি না বললে ফায়ার করবে না কেউ।
মাসাইদের অনেকে, ইংরেজি বোঝে না। দেশীয় ভাষায় সেটা অনুবাদ করে বললো মুগামবি।
বেড়ার ওপাশ থেকে আদেশ শোনা গেল। এগোতে বলছে পোচারদের। আড়াল থেকে বেরিয়ে একটা ফাঁকে এসে দাঁড়ালো সে। দলের আর সবার মতো শুধু নেংটি পরা আধা-উলঙ্গ নয়। গায়ে বুশ জ্যাকেট, পরনে সাফারি ট্রাউজারস। দাড়িতে ঢাকা মুখ, চামড়ার রঙেই বোঝা যায় আফ্রিকান নয় লোকটা।