বেশিক্ষণ এই দৃশ্য দেখা যায় না। জানালার কাছ থেকে সরে এলো ছেলেরা। নীরবে ফিরে চললো ওয়ারডেনের পিছু পিছু। রবিন নীরব। কিশোরের চেহারা থমথমে। মুসার চোখে পানি। পোচার ধরতে টমসনকে সাহায্য করবে কথা দিয়েছিলো ওরা। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো এখন, দলের, সবকটার হাতে হাতকড়া না পরিয়ে টিসাভো থেকে যাবে না।
নটার মধ্যেই লজে ফিরে এলো। নাস্তা করতে বসলো, কিন্তু রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। মুসাও তেমন গিলতে পারছে না। বার বার চোখের সামনে ভাসছে অসহায় বাচ্চাগুলোর চেহারা।
.
০৭.
সেদিনই বেলা বারোটার দিকে এলো তিরিশ জন লোক, লরিতে করে। তাদের স্বাগত জানালেন টমসন। দমে গেলেন মনে মনে। ট্রেইনড রেঞ্জার নয় একজনও। কুলিকামিন গোছের লোক। একজন ট্র্যাকার, আর দুতিন জন পেশাদার শিকারী আছে, এককালে শ্বেতাঙ্গ শিকারীর সহকারী ছিলো ওরা, পয়সার বিনিময়ে টুরিস্টদের নিয়ে সাফারিতে যেতো। কি আর করা? নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো, ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিলেন ওয়ারডেন।
ব্যাণ্ডার পেছনে তাবু খাঁটিয়ে তিরিশ জন লোকের থাকার ব্যবস্থা হলো। খাবার এনে দিলো লজের বাবুর্চিরা।
খেতে খেতে ওদের সঙ্গে আলোচনা চললো। কাজটা কি, জেনেশুনেই এসেছে ওরা। মাসাই উপজাতির লোক, নেহায়েত মাংসের দরকার না হলে কখনও শিকার করে না। পোচারদের ঘৃণা করে। টিসাভোতে ওদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের কাহিনী শুনে জ্বলে উঠলো সবাই। চেঁচাতে শুরু করলো, এক্ষুণি চলুন! কল্লা আলাদা করে ফেলবো ব্যাটাদের! খুন করে ফেলবো!
বুঝিয়ে শুনিয়ে ওদের শান্ত করলেন ওয়ারডেন। বললেন, ব্যাটাদের খুন। করতে পারলে আমিও খুশি হতাম। কিন্তু করা যাবে না। মানুষ খুনের অপরাধে আমাদেরকেই জেলে যেতে হবে তাহলে।
তো কি করবো? এমনি এমনি ছেড়ে দেবো শয়তানগুলোকে? রেগে উঠলো বিশালদেহী এক মাসাই, যেন একটা দৈত্য। ট্র্যাকারের কাজ করেছে অনেক দিন। নাম মুগামবি।
ছাড়বো কেন? ধরে নিয়ে যাবো কোর্টে। ব্যস, আমাদের কাজ শেষ। এরপর ওদেরকে জেলে পাঠানোর দায়িত্ব জজ সাহেবের।
কিন্তু ধরবোটা কিভাবে? পায়ে গুলি করে?
না, বন্দুক নেয়া যাবে না সঙ্গে। উত্তেজনার সময় মাথা ঠিক থাকবে না। পায়ে না করে যদি মাথায় কিংবা বুকে গুলি করে বসে কেউ?
বুঝতে পারছেন না, ওদের সঙ্গে বিষাক্ত তীর আছে, বল্লম আছে। আমরা না মারলেও আমাদেরকে ছাড়বে না ওরা। ঠিক খুন করবে।
তা করবে, স্বীকার করলেন ওয়ারডেন। সেজন্যেই ওদেরকে ধরা খুব বিপজ্জনক হবে। জানোয়ারেরও অধম ওরা।
হাসি মুছে গেছে মাসাইদের মুখ থেকে। খালি হাতে সিংহ ধরতে রাজি আছে ওরা, কিন্তু পোচার নয়।
দেখ, ওদের মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন টমসন। নিজেদের ইচ্ছেয়। এসেছে তোমরা, কাজ করলে পয়সা পাবে, এই শর্তে। যার পয়সার দরকার, যাবে আমার সঙ্গে, যার দরকার নেই, যাবে না। জোর করবো না কাউকে। ধরতে পারলে ধরবো, না পারলে ফিরে আসবো। পুলিশকে জানাবো। যা করার করবে। ওরা। আমি বন্দুক সাথে নিয়ে গিয়ে খুনের আসামী হতে রাজি নই।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছিলো কিশোর। হাত তুললো, স্যার, তীর-ধনুক আর বল্লমও কি নেয়া যাবে না?
না। কারণ ওসব দিয়েও মানুষ খুন করা যায়। মারাত্মক অস্ত্র।
তাহলে, এমন কোনো অস্ত্র যদি নেয়া হয় সঙ্গে, যেটা অবশ্যই মারাত্মক, কিন্তু ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে কততখানি মারাত্মক হবে?
ভুরু কোঁচকালেন ওয়ারডেন। কি বলতে চাইছো?
হাসলো কিশোর। জানোয়ার ধরার অস্ত্র।
খুলে বলো। মনে হচ্ছে কোনো একটা প্ল্যান করেছো তুমি।
খুলে বললো কিশোর।
.
০৮.
কয়েক মিনিট পর যখন রওনা হলো দলটা, দেখা গেল একজন মাসাইও বাদ পড়েনি। সবাই এসেছে। আর এসেছে টমসনের পাঁচজন রেঞ্জার। অন্য পাঁচজন। ক্যাম্পে নেই, ডিউটিতে গেছে পার্কের বিভিন্ন জায়গায়, পোচার খোঁজার জন্যে।
তবে পাঁচজন রেঞ্জারের জায়গা দখল করার মতো পোচার-শিকারী, একটা আছে দলে। মানুষ নয়, কুকুর। মিশ্র রক্ত ওর ধমনীতে। মা, এক শ্বেতাঙ্গ শিকারীর অ্যালসেশিয়ান; বাবা, আফ্রিকার জঙ্গলের ভয়ঙ্করতম শিকারী হিংস্র বুনো কুকুর। বনের মধ্যে অসহায় অবস্থায় বাচ্চাটা কুড়িয়ে পেয়েছিলো সাফারিম্যান কালিমবো, নিয়ে এসে যত্ন করে বড় করে তুলেছে, নাম রেখেছে সিমবা, অর্থাৎ সিংহ। গায়ে গতরে সিংহের সমান না হলেও হিংস্রতায় যে পশুরাজকে ছাড়িয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই মুসার। দেখেই সিমবাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে, মনে মনে। আফসোস করছে, ইস, ওরকম একটা কুকুর যদি থাকতো তার!
পশ্চিমে এগিয়ে চলেছে জীপ, ভ্যান,ট্রাক আর লরির লম্বা মিছিলটা।
একেবারে সামনের ল্যাণ্ড-রোভারে রয়েছেন ওয়ারডেন, গাড়ি চালাচ্ছেন, পাশে কিশোর। মুসা আর রবিন বসেছে পেছনে।
এমনও হতে পারে, টমসন বললেন। লাগতেই আসবে না ওরা। এতোগুলো গাড়ি দেখলেই ভয়ে পালাবে।
ওরা পালাক, এটা নিশ্চয় চান না আপনি? কিশোর বললো। ওদের ধরতে চান।
চাইলেই তো আর হবে না। ওদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে।
আপনার কি মনে হয়, সত্যি পালাবে?
নির্ভর করে। নেতা না থাকলে পালাবে। আর, সিলভার যদি সাথে থাকে, উত্তেজিত করে ওদেরকে, সাহস দেয়, তাহলে আক্রমণ করবে।
আরে, তাই তো! কিশোর ভুলেই গিয়েছিলো সিলভারের কথা।