- বইয়ের নামঃ পোচার
- লেখকের নামঃ রকিব হাসান
- সিরিজঃ তিন গোয়েন্দা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ রহস্যময় গল্প, গোয়েন্দা কাহিনী, রোমাঞ্চকর গল্প
পোচার
০১.
মাউনটেইনস অভ দা মুন! বিড়বিড় করলো কিশোর পাশা, উত্তেজনায় মৃদু কাঁপছে কণ্ঠ।
বাংলায় কি হয়? জিজ্ঞেস করলো রবিন। চাঁদের পাহাড়?
কিংবা চন্দ্রপর্বত! বললো গোয়েন্দাপ্রধান।
নামের মতোই সুন্দর পাহাড়টা, মুসা বললো। নিচের পর্বতশ্রেণীর দিকে তাকিয়ে আছে সে।
দক্ষিণ-পুবে উড়ে চলেছে ছোট্ট বিমান। গন্তব্য, টিসাভো। লোকে বলে রহস্য আর খুনের খুনি টিসাভো। আফ্রিকার বৃহত্তম ন্যাশনাল পার্ক, যেখানে জন্তুজানোয়ারেরা নিরাপদে থাকার কথা, কিন্তু থাকতে পারে না। পোচার, অর্থাৎ চোরাশিকারীরা বেআইনীভাবে মেরে শেষ করছে হাতি, গণ্ডার, জিরাফ, জলহস্তী আর অন্যান্য প্রাণী। তাদের ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন গেম ওয়ারডেন ডেভিড টমসন মুসার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কিন্তু পারছেন না। আর পারবেনই বা কি করে? আট হাজার বর্গমাইল বুনো অঞ্চলের কোথায় যে লুকিয়ে থাকে পোচাররা, খুঁজে বের করা কি সহজ কথা?
প্লেন চালাচ্ছেন টমসন। কপালে, গভীর ভাঁজ পড়েছে, ভাবছেন। কন্ট্রোলে। হাত। নিচে একে একে সরে গেল ভিকটোরিয়া হ্রদ, নীল নদের উৎপত্তিস্থল, সিংহের জন্যে বিখ্যাত বিশাল সেরেংগেটি অঞ্চল, তুষারের মুকুট পরা মাউন্ট কিলিমানজারো…খেয়ালই করছেন না যেন তিনি। তার মন পড়ে আছে আরও দূরের সেই রক্তাক্ত এলাকায়, যেখানে মাঝে মাঝেই চোখে পড়বে রক্ত, আতঙ্ক, অত্যাচার আর মৃত্যুর রোমহর্ষক দৃশ্য।
এক অসম লড়াই, আনমনে বললেন তিনি। শত্রুরা দলে এতো ভারি, কিছুতেই পারছি না। মাত্র দশ জন লোক আমার পোচারদের তুলনায় নগণ্য। কি করে পারবো? এক জায়গা থেকে খেদাই তো পরদিনই আরেক জায়গায় গিয়ে শুরু করে। নাহ, আর পারা যায় না।
কজন গেছে আপনার? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।
বাইশ জন ছিলো। বারো জনকে মেরে ফেলেছে।
তীর দিয়ে?
হ্যাঁ। বিষ মাখানো তীর। পোচারদের সবার কাছে অস্ত্র আছে; তীর-ধনুক, বল্লম, ছুরি, কারো কারো কাছে পুরনো মাসকেট রাইফেল। আমার দুজন লোক ওদের ফাঁদে আটকা পড়েছিলো, জানোয়ার ধরার জন্যে পেতে রাখা ফাঁদ। মাসখানেক পরে ওভাবেই পেয়েছি, শুধু দুটো কঙ্কাল।
খাইছে! আঁতকে উঠলো মুসা। কঙ্কাল?
হ্যাঁ। আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না।
নিশ্চয় পানির অভাবে মরেছে? অনুমানে বললো রবিন। তারপর হায়েনারা এসে খেয়ে ফেলেছে…
আটকা পড়া জীবকে অসহায় দেখলে মরার অপেক্ষা করে না হায়েনারা। আমার বিশ্বাস, জ্যান্তই খেয়ে ফেলেছে।
শিউরে উঠলো রবিন। মুখ কালো হয়ে গেল। মুসার মুখও থমথমে। আফ্রিকায়, তার নিজের মহাদেশে বেড়াতে আসার কথাটা ভাবতে ভালো লাগছে না আর এখন। চট করে তাকালো একবার কিশোরদের দিকে। গোয়েন্দাপ্রধানকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে। তাকিয়ে আছে নিচের দিকে।
এবারের ছুটিতে আফ্রিকায় বেড়াতে আসার প্রস্তাবটা মুসার। রবিন আর কিশোরও শুনেই রাজি। তিনজনে মিলে অনেক বলেকয়ে রাজি করিয়েছে মুসার বাবা মিস্টার রাফাত আমানকে। তিনি সর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ডেভিড টমসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছেন, ছেলেদের পাঠাতে চান। তিন গোয়েন্দার সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও জানিয়েছেন বন্ধুকে। বন্ধুর অনুরোধ এড়াতে পারেননি। ওয়ারডেন, কিংবা এড়াতে চানওনি হয়তো, তাই তিন কিশোরকে কিছুদিন মেহমান রাখতে রাজি হয়ে জবাব দিয়েছেন চিঠির।
ছেলেদের মনমরা হয়ে যেতে দেখে হাসলেন ওয়ারডেন। কি ব্যাপার, ভয় পেয়ে গেলে নাকি?
না না, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। ভয় পাবো কেন? বিপদকে ভয় পাই না আমরা।
রাফাতও তাই লিখেছে। তোমরা ভীষণ সাহসী। আমাজানের গহীন জঙ্গল থেকেও জন্তুজানোয়ার ধরে নিয়ে এসেছিলে। এসব শুনেই রাজি হয়েছি। নইলে যেখানে পোচার আছে, আসতে বলতাম না। পোচার মানেই তো বিপদ।
দশজন আছে তো, মুসা বললো। এখন ধরে নিতে পারেন তেরো জন। আমরাও আছি আপনার সঙ্গে। ওই পোচার ব্যাটাদের একটা ব্যবস্থা না করে আমরাও আমেরিকায় ফিরছি না।
দেশপ্রেম?
দেশপ্রেমিক, বুনো পশু-পাখি-প্রেমিক, অন্যায়-বিরোধী, যা খুশি বলতে পারেন। কিন্তু টিসাভোর ওই পোচারগুলোকে খতম না করে আমি মুসা আমান অন্তত ফিরছি না।
এক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে নিগ্রো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন টমসন। তারপর মাথা নাড়লেন, তোমার বাবা মিথ্যে লেখেননি। সত্যি তোমরা ভালো ছেলে।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার, কিশোর বললো।
ওই যে, তুষারে ঢাকা পর্বতের একটা ধার দেখিয়ে বললেন ওয়ারডেন। ওই টিসাভো।
চমৎকার দৃশ্য! কে ভাববে, ওরকম একটা জায়গায় সারাক্ষণ চলে মৃত্যুর আনাগোনা? সবুজ বন, দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমি, নিঝুম পাহাড়, রূপালি নদী, শান্ত হ্রদ, উজ্জ্বল রোদ, নিবিড় ছায়া-সবকিছু মিলিয়ে তিন গোয়েন্দার মনে হলো যেন পৃথিবীর কোনো জায়গা নয় ওটা।
সুন্দরের পুজারি কিশোর পাশার স্বপ্নিল চোখ দুটো আরও গাঢ় হয়ে উঠলো। ভাবছে, বাংলাদেশেও কি এতো সুন্দর জায়গা আছে?
আল্লাহরে! এ-তো বেহেশত! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।
হ্যাঁ, মাথা দোলালো রবিন। সুন্দর জায়গা পৃথিবীর সবখানেই আছে। আমাদের আয়ারল্যাণ্ডেও আছে।