ভয় পান না?
মাথা নাড়ল ভিকি। কারও কোন ক্ষতি তো করে না। ভয় পাব কেন? আমার আশঙ্কা অন্যখানে। গুজব ছড়িয়ে গেলে টুরিস্টরা আসবে না।
এ বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে কেন বলতে পারেন?
ঘন ঘন কয়েকবার কাপে চুমুক দিল ভিকি। এ বাড়ি যে বানিয়েছে, তারই প্রেতাত্মা হয়তো ওটা। স্বাভাবিক মৃত্যু তো হয়নি বেচারার।
কেন, কি হয়েছিল?
সিঁড়ি থেকে পড়ে মরেছে।
খুলেই বলুন না।
ওর নাম ছিল ডানকান লেমিল। ভাল আর্টিস্ট ছিল। এখানকার সমস্ত, কাচিনা সে-ই এঁকেছিল। শোনা যায়, লেমিল নাকি হোপি ইনডিয়ানদের কাছ থেকে খুব মূল্যবান একটা জিনিস চুরি করেছিল, লুকিয়েছিল এনে এই বাড়িতে। ইনডিয়ানদের সর্দার এসে জিনিসটা ফেরত চাইল, দিতে রাজি হলো না লেমিল। ভয় দেখাল সর্দার, না দিলে পুড়িয়ে মারবে। কিন্তু দিল না লেমিল। সে সময় তার ছবির এক ভক্ত ছিল এ বাড়িতে। যেদিন সর্দার শাসিয়ে গেল তার পরদিন সকালে সিঁড়ির গোড়ায় মৃত পাওয়া গেল লেমিলকে। শরীরের কোথাও কোন ক্ষত নেই। তার ভক্তকেও খুঁজে পাওয়া গেল না, একেবারে গায়েব। লেমিল কিভাবে মরল সেটা এক রহস্য। কেউ বলে ইনডিয়ানদের ভয়ে হার্টফেল করে মরেছে, কেউ বলে তার ভক্তই তাকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলে রেখে পালিয়েছে। কোনটা ঠিক কে জানে! কোনটাই প্রমাণিত হয়নি।
হুঁ, তারপর?
তারপর আর কি? ভূতের গল্প চালু হলো। লেমিলের মৃত্যুর জন্যে ভূতকে দায়ী করল কেউ।
ঠাণ্ডা হয়ে আসা বাকি চা-টুকু দুই ঢোকে শেষ করে পিরিচে কাপটা নামিয়ে রাখল কিশোর। কি জাতের ভূত? ক্যাচিনা?
হতে পারে। আমরা আসার পর থেকে তো ক্যাচিনাই দেখা যাচ্ছে, অন্য কিছু না।
চুপ করে ভাবল কিশোর। আচ্ছা, অভিশাপ যে আছে, কিসের অভিশাপ?
ইনডিয়ানদের। লেমিলের মৃত্যুর জন্যে শেষ পর্যন্ত ইনডিয়ান সর্দারকে দায়ী করে বসল এখানকার কিছু র্যাঞ্চার। রেগে গিয়ে দেশছাড়া করে ছাড়ল সর্দারকে। পালিয়ে মেকসিকোয় চলে যেতে বাধ্য হলো সে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে একা একা খুব কষ্ট পেয়ে মরেছে বেচারা। তার স্ত্রী অনেক কেঁদেছে। লেমিলকে অভিশাপ দিয়েছে।
সেজন্যেই ক্যাচিনা ভূত এসে আস্তানা গেড়েছে এখানে?
মাথা নাড়ল ভিকি। জানি না। শুধু সর্দারই নয়, আরও কিছু হোমরা চোমরা ইনডিয়ানও বিপদে পড়ে গিয়েছিল। কেউ লজ্জায় আত্মহত্যা করেছে, কেউ সর্দারের মত দেশছাড়া হয়েছে। তারাও
অভিশাপ দিয়েছে লেমিলকে।
কিন্তু শুধু এই বাড়িতেই কেন ভূতের আনাগোনা?।
কারণ এই বাড়িতেই অপঘাতে মরেছে লেমিল, এই বাড়িতেই জিনিসটা লুকিয়েছিল সে, এবং তার মৃত্যুর পরও আর ওটা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তার মানে, কিশোরের ভুরুজোড়া সামান্য কাছাকাছি হলো, বলতে চাইছেন, জিনিসটা এখনও এ বাড়িতেই আছে?
ছয়
লোকের তো তাই বিশ্বাস, ভিকি বলল। দু-চারজন বাদে। তারা বলে ভক্ত ব্যাটাই লেমিলকে খুন করে জিনিসটা নিয়ে পালিয়েছে।
অসম্ভব না। নাকে বালিশ চাপা দিয়ে দম বন্ধ করে মারলে ক্ষত থাকে না, বলল কিশোর। তা জিনিসটা কি? কোন ধারণা আছে?
মূল্যবান কোন পাথর-টাতর হবে।
পাওয়া গেলই না, না? চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর।
না। লেমিল মারা যাওয়ার পর এই বাড়ির ভেতরে-বাইরে তন্ন তন্ন করে খুঁজছে লোকে। পায়নি।…আরেক কাপ চা দেব?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। যাক, অনেক কিছু জানা গেল আপনার কাছে।
আমি চাই রহস্যটার একটা সমাধান হোক, যাতে রিসোর্টটা ঠিকমত চলে। মিস্টার উইলসনের কাছে অনেক দিন আছি। ভাল লোক, তার কোন ক্ষতি হোক চাই না। বিষণ্ণ শোনাল মহিলার কণ্ঠ, আর, প্লীজ, জুলিয়ানের বদনাম যদি একটু ঘোচাতে পারো। বিশ্বাস করো, ও খুব ভাল ছেলে। ওকে এখান থেকে বের করে দিলে আমার খুব কষ্ট লাগবে। বাপ নেই ছেলেটার, এতিম, সেজন্যেই তো পরের দয়া চাইতে এসেছে… গলা ধরে এল ভিকির। ছলছল করে উঠল চোখ।
তাড়াতাড়ি হাত তুলল কিশোর। আহাহা, এত অস্থির হওয়ার কি। আছে? সাধ্যমত চেষ্টা করব আমরা।
উঠল কিশোর। শূন্য, নীরব হলরুম দিয়ে ফিরে এল আবার নিজের ঘরে।
পরদিন ঘুম ভাঙতে অনেক বেলা হলো। হাতমুখ ধুয়ে জিনসের প্যান্ট আর গাঢ় লাল ঝলমলে সিল্কের শার্ট পড়ল, এই ওয়েস্টার্ন অঞ্চলের মানানসই পোশাক। বেরোল।
পেছনের বাগানে বসে চা খাচ্ছে মুসা, রবিন আর জিনা। টেবিলে পড়ে আছে শূন্য প্লেটগুলো, নাস্তা শেষ।
আরিব্বাপ! কিশোর পাশা দ্য গানম্যান, দেখেই বলে উঠল মুসা। ভুরু নাচাল।তা, মিয়া, কোমরে পিস্তল কই?
হাসল সবাই।
মুসার পায়ের কাছে শুয়ে ছিল কুকুরটা, হাসাহাসি শুনে উঠে বসল। কৌতূহলী চোখে তাকাল কিশোরের দিকে।
আরে, বাঘাটা না? কিশোর বলল। জনির সেই শিকারী কুকুর, টাইগার।
হ্যাঁ, জিনা বলল। ভিকিখালা এমন খাওয়ানো খাওয়ায়, চুরি তো দূরের কথা, অন্য কেউ সেধে দিলেও এখন আর কিছু খেতে চায় না। ভাল হয়ে গেছে।…আমাদের খুব খিদে পেয়েছিল, থাকতে পারলাম না, খেয়ে নিয়েছি। শুনলাম, কাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকেছ-ভিকিখালা বলল-তাই আর ডাকলাম না।
ভাল করেছ, বসতে বসতে বলল কিশোর। কি ঘটেছিল, বলেছে? রাতের বেলা হলরুমের আবছা আলো-আঁধারিতে যা যা ঘটেছে এখন নিজেরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না সে-সব। রাতে চাঁদের আলোয় পরিবেশ ছিল এক রকম, এখন উজ্জ্বল সূর্যালোকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম হয়ে গেছে। কড়া রোদ, কমলা ফুলে মৌমাছির গুঞ্জন, চোখ ধাঁধানো আলোয় বসে রাতের ব্যাপারটাকৈ স্বপ্ন মনে হচ্ছে এখন।