ঘরে থাকলে ঢুকতেও পারে, হাসল টনি। তবে মনে হয় নেই। গত হপ্তায় আরেকবার ঘর ঝাড়া দিয়েছি।
তাহলে কিশোরের সুটকেসে এল কোত্থেকে?
বোধহয় বাইরে থেকে।
ঠিক, আমিও একমত, আঙুল তুলল কিশোর, বাইরে থেকেই এসেছে। তবে, নিজে নিজে ঢোকেনি। ঢোকানো হয়েছে।
মানে? ভুরু কোঁচকাল টনি।
মানে সুটকেস তালা দেয়া ছিল। পরে খোলা পেয়েছি। বিছেটাকে ঢুকিয়ে রেখে তালা আটকানোর কথা মনে ছিল না বোধহয়, আর, আড়চোখে টনির দিকে তাকাল কিশোর।
কে ঢোকাতে যাবে? কেন?
এই চিঠিটা দেখলেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারবে, কেন ঢুকিয়েছে, এক লাইনের চিঠিটা বের করে দিল কিশোর। তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করছে টনিকে।
হাসি হাসি মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল টনির। হু! অ্যাক্সিডেন্টও তখন ইচ্ছে করে ঘটাতে চেয়েছে।
তাই কি মনে হয় না?
জবাব দিল না টনি।
সারাদিন অনেক ধকল গেছে তিন গোয়েন্দার ওপর দিয়ে। ভ্রমণের পরিশ্রম আর উত্তেজনা চাপ দিতে আরম্ভ করেছে শরীরের ওপর। ক্লান্তি বোধ করছে ওরা। তাড়াতাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ার তাগিদ অনুভব করছে। তিনজনেই।
খানিকক্ষণ চুপ করে রইল সবাই। অবশেষে জিনা বলল, ভাবছি, এখানকার কয়েকজন বন্ধুকে দাওয়াত করব কাল। আজ গিয়ে ঘরেই শোও, কাল মরুভূমিতে রাত কাটাব। আগুনের পাশে। আস্ত ভেড়া রোস্ট হবে…
তাই নাকি? সোফার হাতলে চাপড় মারল মুসা। দারুণ হবে।
যদি অবশ্য কাঁকড়াবিছে না থাকে ওখানে, রবিন যোগ করল।
থাকুক, রসিকতা করল মুসা। বিছেকেই কাবাব বানিয়ে খেয়ে ফেলব।
তা অবশ্য তুমি পারো, হাসন রবিন।
জিনাও হাসল। যাও, তাগাদা দিল সে, আর বসে থেকে লাভ নেই। সকাল সকাল গিয়ে শুয়ে পড়ো।
খুশি হয়েই উঠে পড়ল তিন গোয়েন্দা।
কিন্তু প্রচণ্ড ক্লান্তি সত্ত্বেও বিছানায় শুয়ে ঘুম এল না কিশোরের। ঘরের একটিমাত্র জানালা, চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরে। জানালার লাগোয়া প্যালো ভারডে গাছটা কেমন ভূতুড়ে লাগছে ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়। জুলিয়ানের সঙ্গে আর দেখা হয়নি, কিন্তু খানিক আগে গলা শুনেছে তার। আচ্ছা, ওইটুকুন ছেলে এত্তসব গোলমাল পাকিয়েছে? নাহ, বিশ্বাস হয় না। কিন্তু ওর সঙ্গে শত্রুতা করেই বা কার কি লাভ? আগুন লাগানো, ঘোড়া চুরির দায় ছেলেটার ওপর কেন চাপাতে চাইবে?
ক্যাচিনা পেইন্টিংগুলোও অস্থির করে তুলেছে তার মনকে। সুন্দর। এ ধরনের রিসোর্টের জন্যে মানানসই। কিন্তু বড় বেশি বিষণ্ণ। মন খারাপ করে দেয়। ঘরের পরিবেশই কেমন যেন বদলে দিয়েছে। ওখানে ভূত আছে বললে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বলতে পারবে না কিশোর। চোখ মেলে জানালার দিকে চেয়েই বুঝল, অনেক সময় পেরিয়েছে। সরে চলে গেছে। চাঁদ, জ্যোত্স আর ঘরে আসছে না এখন। কেন হঠাৎ ঘুম ভাঙল? দীর্ঘ এক মুহূর্ত চুপচাপ পড়ে রইল সে, তারপর আবার শুনল শব্দটা। ও, এ জন্যেই ভেঙেছে! ঘুমের মধ্যেও ওই শব্দ কানে ঢুকেছে। হলরুমে বিচিত্র শব্দ।
আস্তে করে উঠে বসে অভ্যাস মাফিক পা ঢুকিয়ে দিল, জুতোতে। দিয়েই চমকে উঠল, টনি না বলেছিল ভালমত না দেখে না ঢোকাতে! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পরক্ষণেই, না, নেই। বিছে-টিছে কিছু লাগল না পায়ে। পা টিপে টিপে এগোল দরজার দিকে। নিঃশব্দে খুলল। দু-দিকে ছড়ানো হলরুম, জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে চাঁদের আলো। তাতে জানালার কাছে অন্ধকার কিছুটা কেটেছে বটে, কিন্তু আসবাবপত্রের আশপাশে, দেয়ালের ধারে, আর ঘরের কোণে চাপ চাপ অন্ধকার।
দেয়ালের ছায়া থেকে বেরোল ওটা। বেগুনি আলোর একটা ঘূর্ণিমত, পাক খেতে খেতে এগোচ্ছে কিশোরের দিকে। ঘরের মাঝামাঝি এসে থমকে গেল। অদ্ভুত সব রূপ নিতে লাগল। একবার। মনে হলো কোন মহিলার ছায়া, তারপর পুতুল, পরক্ষণেই আবার গাছ কিংবা ভালুক, সবশেষে হয়ে গেল আকাশের ভাসমান মেঘের মত। তবে রঙের কোন পরিবর্তন হলো না কখনওই। অদ্ভুত একটা আওয়াজ হচ্ছে, বোধহয় আজব জিনিসটাই করছে বিচিত্র গান। বিটকেলে সুর। কথা কিছুই বোঝা যায় না।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর। কি করবে বুঝতে পারছে না। এই সময় সিঁড়িতে শোনা গেল পদশব্দ। নেমে আসছে কেউ। ক্লিক করে অন হলো সুইচ, আলো জ্বলল।
ম্লান হলো বেগুনি আলো, দেয়ালের দিকে ছুটে গিয়ে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কি, কিশোর? জিজ্ঞেস করল ভিকি। সুইচবোর্ডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে অবাক হয়ে।
দেখলেন না?
বেগুনি আলোর মত কি যেন চোখে পড়ল। ভালমত দেখিনি।
রান্নাঘরে চলুন না? এখানে কথা বললে অন্যরাও জেগে যাবে। জাগিয়ে লাভ নেই। ঘুমাক।
বেশ, চলো। : রান্নাঘরে ঢুকে ভিকি বলল, চা খাবে? এক ধরনের ভেষজ সুগন্ধী দিয়ে চা বানাতে শিখেছি, ইনডিয়ানরা বানায়। খেয়ে দেখো, ভাল লাগবে। যেদিন ঘুম আসতে চায় না, বানিয়ে খাই।
বানান। একটা চেয়ারে বসল কিশোর। খালা, বোধহয় ক্যাচিনা ভূতটাকেই দেখলাম।
অবাক হলো না ভিকি। যেন এটাই স্বাভাবিক, এমন ভঙ্গিতে মাথা ঝকাল। দু-কাপ চা বানিয়ে এনে রাখল টেবিলে। হাতে বানানো কয়েকটা বিস্কুট দিল একটা প্লেটে করে।
চায়ে চুমুক দিল কিশোর। বাহ্, সত্যিই তো! দারুণ সুগন্ধ।
ভূতটাকে দেখেছ তাহলে?
হ্যাঁ। আপনি দেখেছেন?
আবার মাথা ঝাঁকাল ভিকি, দেখেছি। আরও অনেকেই নাকি দেখেছে। লোকে বলে বহুদিন ধরে আছে এটা এ-বাড়িতে। একেক সময় একেক রূপে দেখা দেয়, পূর্ণিমার সময়।