সব কিছুরই ব্যবস্থা থাকবে এখানে।
শুনতে ভাল লাগছে, বলল কিশোর। টুরিস্ট আকর্ষণের চমৎকার ব্যবস্থা। সাধারণ রিসোর্টের চেয়ে আলাদা।
হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল জিনার ঠোঁটে। যদি ক্যাচিনার অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলে। ভূতের উপদ্রব ঘটতে থাকলে একজন লোকও আসবে না।
ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে কি বলল টনি, বোঝা গেল না। রাস্তা শেষ, ড্রাইভওয়েতে পড়েছে গাড়ি। গাড়িপথের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এখনও, এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে। এগিয়ে গেছে পুরানো বাড়িটার দিকে। মেসকিট ঝোঁপ আর ক্যাকটাস ঘন হয়ে জন্মেছে সামনের দিকে। গাড়িপথ ধরে বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়ে মোড় নিতেই সামনের দৃশ্য দেখে প্রায় চমকে গেল তিন গোয়েন্দা।
পেছনে রুক্ষ মরুর বিশাল বিস্তার, তাতে পুষ্পশূন্য ধূলিধূসরিত ক্যাকটাস, মাঝে পাতাবাহারের নিচু বেড়া। বেড়ার এপাশে সবুজের সমারোহ, ঝিক করে চোখে লাগে। ঘন সবুজ রসাল ঘাসে ঢাকা লন, রঙিন ফুলের ঝাড়, কমলা লেবুর বাগান। কমলার গন্ধ ভুরভুর করছে। গরম বাতাসে। বিরাট বাগানের ঠিক মাঝখানে সুইমিং পুল, স্ফটিকের মত স্বচ্ছ পানিতে আকাশ দেখা যায়, মনে হয় পানির রঙই বুঝি ঘন নীল। তার পাশে ধবধবে সাদা একটা বাড়ি। সব কিছুই সাজানো গোছানো, যেন ছবি। এখনও নাকি পুরোপুরি তৈরিই হয়নি। হওয়ার পর কি হবে ভেবে অবাক হলো ওরা।
আরিব্বাবা, দারুণ! সহজে প্রশংসা করে না যে কিশোর পাশা, তার মুখ দিয়েও বেরিয়ে গেল এই কথা।
পছন্দ হয়েছে, না? হেসে বলল টনি। তারমানে সফল হয়েছি। আমরা। দর্শককে চমকে দিতে পেরেছি।
রূপকথার রাজ্য মনে হয়, বিড়বিড় করল রবিন।
মরুভূমিতে মরূদ্যান, মুসা বলল।
গাড়ি রাখল টনি। নামল সবাই।
সাঁতারের পোশাক এনে তো ভালই করেছি দেখা যায়, সুইমিং পুলটার দিকে লোভাতুর নয়নে তাকিয়ে আছে মুসা। কি, রবিন, খুব তো হাসাহাসি করেছিলে, মরুভূমিতে ব্যাদিং সুট দিয়ে কি করব বলে বলে; এখন?
জিনা, টনি বলল, তুমি ওদের নিয়ে এসো। আমি ভিকি আন্টিকে খবর দিচ্ছি। দুই হাতে বিশাল দুই সুটকেস তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোল সে।
ওদিকে আরও গোটা তিনেক বাংলো বানানোর ইচ্ছে আছে চাচার, মরুভূমির দিকে দেখিয়ে বলল জিনা। আরও ছয়জনের জায়গা হবে তাহলে।
ভালই প্ল্যান করেছেন তিনি, দেখতে দেখতে বলল কিশোর। লোকে ভাববে মরুভূমিতে যাচ্ছে, দেখবে শুধু বালি আর বালি। এসে যাবে চমকে, আমাদের মত। মরুভূমিও আছে, আবার সবুজও আছে। কষ্ট করতে হবে এটা ধরে নিয়েই আসবে, এসে পাবে এই আরাম। ফলে আরামটা আরও বেশি মনে হবে।
ইচ্ছে করলে ঘোড়ায় চড়ে চলে যাওয়া যায় পর্বতের ওদিকে, জিনা বলল। চাইলে ওখানে রাত কাটানো যায়। আহ, কি যে মজা! আমি একবার গিয়েছিলাম। রাতে আগুনের কিনারে শুয়ে মনে হলো, দেড়শো বছর পিছিয়ে চলে গেছি সেই বুনো পশ্চিমে… দরজা খুলতে দেখে থেমে গেল সে।
ভিকি বেরিয়ে ছুটে এল দু-হাত বাগিয়ে। তোমরা এসেছ। যাক, নিশ্চিন্ত হলাম। সূক্ষ্ম একটা দুশ্চিন্তার ছায়া দেখা গেল তার চেহারায়।
কোনরকম ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল কিশোর, কি হয়েছে, খালা? খারাপ কিছু?
খানিক আগে ডাক্তার এসেছিল, জানতে, জুলিয়ান একটা অ্যাপলুসা নিয়ে এসেছে কিনা।
কী? ভুরু কোঁচকাল জিনা।
অস্বস্তি ফুটল ভিকির চোখে। ডেনিংদের আস্তাবলে নাকি একটা ঘোড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কে জানি জিংম্যানকে বলেছে, একটা মাদী ঘোড়াকে টেনে আনতে দেখা গেছে একটা ছেলেকে। এদিক-ওদিক তাকাল। সাদাকালো পিন্টো ঘোড়ায় চেপেছে ছেলেটা।
ওটায় চড়ে এখানে এসেছিল নাকি?
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল ভিকি। বাড়িই আসেনি সারাদিন। গতরাতে মিস্টার উইলসন হাত-পা ভাঙায় ভীষণ ঘাবড়ে গেছে সে। মনমরা হয়ে আছে তারপর থেকে। সকালে খেয়ে সেই যে বেরিয়েছে, আর দেখিনি তাকে।
কোথায় দেখা গেছে তাকে, জিংম্যান কিছু বলেছে?
মাথা নাড়ল ভিকি।
ডিনারের দেরি আছে। মেহমানদের দেখিয়ে বলল জিনা, ওদেরকে ওদের ঘরে দিয়ে আসি। তারপর দেখি, আমি আর টনি খুঁজতে বেরোব। তুমি কিছু ভেব না, খালা। ওই চেরিই একমাত্র সাদাকালো পিন্টো ঘোড়া না এখানে, আরও আছে। আর জুলিয়ানের বয়েসের ছেলেও আছে। অন্য কাউকেও দেখে থাকতে পারে ওই লোক।
হাসল ভিকি, কিন্তু ভাবনার কালো ছায়া দূর হলো না চেহারা থেকে।
সাদাকালো ঘোড়ায় চড়ে আসতে দেখা গেল একটা ছেলেকে। দড়িতে বেঁধে টেনে আনছে একটা ছাইরঙ মাদী অ্যাপলুসা ঘোড়া, পেছনটা ভারি সুন্দর, সাদার ওপর ছাই রঙের ফোঁটা। চকচকে চামড়া থেকে যেন তেল চুঁইয়ে পড়ছে।
অ্যাই, ফুপু, দূর থেকেই ডেকে বলল ছেলেটা, দেখো, কি এনেছি। মরুভূমিতে ঘুরছিল, ধরে নিয়ে এলাম। সুন্দর, না?
জুলিয়ান, কেঁদে ফেলবে যেন ভিকি, কেন…
হাত তুলে ভিকিকে চুপ করাল কিশোর। জুলিয়ান আরও কাছে এলে জিজ্ঞেস করল, মরুভূমিতে পেয়েছ? এগিয়ে গেল সে।
লাজুক হাসি হাসল জুলিয়ান, অনেকটা মেয়েলি চেহারা। অ, তোমরা এসে পড়েছ। তোমাদের কথা শুনেছি ফুপুর কাছে। তুমি নিশ্চয় কিশোর পাশা!
হ্যাঁ। আর ও…
বোলো না, বোলো না। শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। ও মুসা আমান, আর ও রবিন মিলফোর্ড।…হা, কি যেন বলছিলে…মরুভূমিতে পেয়েছি নাকি ঘোড়াটাকে? হ্যাঁ, পেয়েছি। ছাড়া পেয়ে ঘুরছিল। ডাকতেই কাছে চলে এল। বড় রাস্তায় চলে গেলে তো আর পাওয়া যেত না, ডাকলেই যখন কাছে যায়, কে না কে ধরে নিয়ে যেত। আমি নিয়ে এলাম, ভাল হলো না?