মিস্টার উইলসন হলে নেমেছিলেন বাইরে বেরোনোর জন্যে, আগুন দেখে। আর ওই আগুনের জন্যে ছেলেটা দায়ী। দুটো বড় ক্যাকটাস আর একটা প্যালো ভারডে গাছ ইতিমধ্যেই পুড়িয়ে ছাই করেছে।
সেটা তোমার অনুমান, প্রতিবাদ করল জিনা। আগুন যে জুলিয়ান লাগিয়েছে, তুমি শিওর হয়ে বলতে পারবে?
দ্বিধা করল টনি। এ ছাড়া আর কে লাগাবে? সারাক্ষণ র্যাঞ্চের চারপাশে ছোঁক ছোঁক করে বেড়ায়, আগুন জ্বালে…
আমি বিশ্বাস করি না। ভিকিখালাও না।
কিন্তু আগুন তো একবার সে লাগিয়েছিল, নাকি?
তা লাগিয়েছিল, তবে সেটা এমন কোন ব্যাপার না। কিশোরের দিকে ফিরল জিনা। এ দেশের লোক আর তাদের আচার-আচরণ সম্পর্কে জানতে খুব আগ্রহী জুলিয়ান। হাজার হোক, বাপের কুলের লোকদের কথা কে না জানতে চায়? সিনেমা আর টেলিভিশন থেকে নানারকম আইডিয়া নেয় ও। একটা পুরানো ফিল্মই তার মাথায় ঢুকিয়েছে স্মোক সিগন্যালের ব্যাপারটা। পাহাড়ের ওপর চড়ে ধোয়ার সিগন্যাল দিতে গিয়েছিল, একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে…এ রকম আর কখনও করবে না, কথা দিয়েছে।
তোমার চাচা যে আলো দেখল, ওটা কিসের আলো?
জানি না।
হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে দেখতে গিয়েছিলাম, জিনার কথার পিঠে বলল টনি। আগুনের কোন চিহ্ন দেখলাম না। মরুভূমিতে হয় এ রকম। জ্বলে ছাই হয়ে যায় জিনিস, বাতাসে বালি উড়িয়ে এনে তার ওপর ফেলে ঢেকে দেয় সব নিশানা।
চাঁদের আলোর কারসাজিও হতে পারে। মনে ভূতের ভাবনা থাকলে কত কিছুই তো দেখে মানুষ, জিনা বলল।
জুলিয়ানের তাহলে বদনাম হয়ে গেছে খুব, না? আনমনে বলল কিশোর।
হ্যাঁ। ও আসার পর থেকেই অদ্ভুত কিছু কাণ্ড ঘটেছে। কয়েক জায়গায় আগুন লেগেছে। ভূতটাও ঘনঘন দেখা দিচ্ছে। কিশোর, আমি বলছি ছেলেটা নির্দোষ। অনুরোধের সুরে বলল জিনা, তুমি ওর বদনাম ঘোচাও।
আমি? ভুরু কোঁচকাল কিশোর। কিভাবে? অকাজগুলো যদি সত্যি সত্যি করে থাকে সে? আগুন লাগিয়ে থাকে?
শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে গাড়ি। পথের দু-ধারে পামের সারি, তার ওপাশে খানিক পর পরই লেবু বাগান। সেদিকে চেয়ে মাথা নাড়ল জিনা, ও করেনি। তুমি তদন্ত করলেই বুঝতে পারবে। কিছু একটা রহস্য রয়েছে লস্ট ভ্যালি রিসোর্টে। কিশোরের দিকে ফিরল। জুলিয়ান স্বীকার করেছে, সে একবার আগুন জ্বেলেছে সিগন্যাল দেয়া প্র্যাকটিস করার জন্যে। কিন্তু রাতে গেট খুলে রাখা, ঘোড়ার বাধন খুলে ওগুলোকে ছেড়ে দেয়া, ও সব শয়তানীর কোনটাই সে করেনি। ভিকিখালা তার কথা বিশ্বাস করে, আমিও করি। অনেক রকমে চেষ্টা করেছে ভিকিখালার স্বামী; ভয় দেখিয়ে বলেছে, মিথ্যে কথা বললে আবার তাকে ভিয়েতনামে তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবে। কেঁদে ফেলেছে জুলিয়ান। কসম খেয়ে বলেছে, সে ওসব কিছুই করেনি।
ঠিক আছে, দেখা যাক, নিচের ঠোঁটে জোরে একবার চিমটি কাটল কিশোর। আগে ভেবেছিল, একটা রহস্য, এখন দেখা যাচ্ছে। দুটো। অ্যারিজোনা মরুভূমিতে ছুটি ভালই কাটবে মনে হচ্ছে।
র্যাঞ্চ আর কদ্দূর? প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্যে বলল মুসা।
দূর আছে এখনও, জানাল টনি। ওই যে, দূরে, সুপারস্টিশন মাউনটেইন, পুবে দেখাল সে। মরুর বুক থেকে উঠে গেছে উঁচু গিরিশৃঙ্গ।
নীল চুড়া এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব কিছু ছাড়িয়ে, মনে হয় সাদা মেঘ ফুঁড়ে যায়, একেবারে উড়ে যায়, আকাশের কোণটিতে। কোথা পাবে পাখা সে…
হেই, কি বিড়বিড় করছ? কনুই দিয়ে তো লাগাল মুসা।
বাধা পেয়ে থেমে গেল কিশোর। অ্যাঁ! ও, না, একটা বাংলা কবিতা অ্যাডাপ্ট করছিলাম।
আচ্ছা, সুপারস্টিশন মাউনটেইনের বাংলা কি হয়?
কুসংস্কার পর্বত। উদ্ভট নাম।
আর লস্ট ভ্যালি? রবিন জিজ্ঞেস করল।
হারানো উপত্যকা।
জিনা, রসিকতার সুরে বলল মুসা, কুসংস্কার পর্বতের হারানো উপত্যকায় পোড়ো খনিটনি আছে নাকি, ওই যে, টুইন লেকসের মৃত্যুখনির মত? রহস্যটা জমে তাহলে ভাল।
আছে, লস্ট ডাচম্যান মাইন, হাসল টনি। অ্যাপাচি জাংশনে গেলেই দেখবে, টুরিস্টদের কাছে ম্যাপ বিক্রি করছে ফেরিয়ালারা, ওখানে যাওয়ার।
পথে পড়বে নাকি? জিজ্ঞেস করল রবিন।
হ্যাঁ। ছোট একটা টাউন। তার পরেই আমাদের র্যাঞ্চ।
আরিব্বাবা, কত দূরে চললাম! মুসা বলল।
তাতে কি? টিপ্পনী কাটল জিনা। আমরা সব্বাই ঘিরে রাখব। তোমাকে, ক্যাচিনা যাতে তোমাকে ধরতে না পারে।
আমি কি ভয় পাই নাকি? বললাম, সভ্য জগৎ থেকে কত দূরে চলে এসেছি…একেবারে ওয়াইল্ড ওয়েস্ট…
বুনো পশ্চিম, বাংলায় বিড়বিড় করল কিশোর।
প্রথম প্রথম এসে আমারও খারাপ লাগত, বলল জিনা। এখন তো আর এ জায়গা ছেড়ে যেতেই মন চায় না। আহ, কমলা বাগান। এসে পড়েছে! কি সুন্দর গন্ধ!
মরুর হালকা বাসন্তী বাতাসকে ভারি করে তুলেছে কমলা ফুলের মিষ্টি সুবাস।
জোরে শ্বাস টেনে গন্ধ নিল কিশোর। আউফ, সত্যি চমৎকার!
এটাকে চমৎকার বলছ, আরও আগে এলে বুঝতে, চমৎকার কাকে বলে, বলল টনি। ফুল তো এখন অনেক কম, মৌসুম প্রায় শেষ। ভরা। মৌসুমে রাশি রাশি ফুল ফোটে, কমলা আর পাকা আঙুরের গন্ধে মৌ মৌ করে বাতাস। আমাদের র্যাঞ্চেও আছে কিছু গাছ। ফলও ধরেছে। পাকা আঙুর আর কমলা নিজেরাই ছিঁড়ে নিয়ে খেতে পারবে।
খাইছে! তাই নাকি? তর সইছে না আর মুসার। তা, ভাই, তাড়াতাড়ি করো। দিলে এমন এক কথা শুনিয়ে, ধৈর্য রাখতে পারছি না। আর।