সেই অভিজ্ঞতা পেকেরও হলো। তো খেয়ে বাপরে! বলে চেঁচিয়ে উঠে ধাক্কা খেল গিয়ে হাঁটু চেপে ধরে রাখা বসের গায়ে। তাকে নিয়ে পড়ল মেঝেতে। হাত থেকে পড়ে ভাঙল লণ্ঠন, আলো নিভে গেল।
দরজার দিকে দৌড় দিল মুসা। লাফিয়ে এসে নামল চৌকাঠের বাইরে।
ক্যাম্পফায়ারের আলোতে নাচছে ঝোঁপঝাড় আর গাছের ছায়া। দেখার সময় নেই, মাথা নিচু করে ছুটছে মুসা। ছোট ঝর্নাটার ধার দিয়ে এসে ঢুকল, একটা ঘন ঝোপে। থামল। হাপরের মত ওঠানামা করছে। বুক। ফিরে তাকাল। সাময়িক মুক্তি পেয়েছে বটে, কিন্তু এই পাহাড়ের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারবে কিনা সন্দেহ।
বেরিয়ে এসেছে তিন বদমাশ।
গিরিপথের মুখ আটকাও! আগুনে আরও লাকড়ি ফেলো! টর্চ আনো! ওকে পালাতে দেয়া যাবে না! চিৎকার করে একের পর এক নির্দেশ দিয়ে চলল জিংম্যান।
খুব সাবধানে ঝোঁপের ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল মুসা। বৃষ্টিকে ধন্যবাদ, ডালপাতা ভিজিয়ে রেখেছে। শুকনো নয়, ফলে খড়খড় শব্দ হচ্ছে না। অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। সামনে দেখল পাথুরে পাহাড়ের ঢাল। এগোল সেদিকে। বড় পাথরের চাঙড়ের আড়াল, নিদেনপক্ষে একটা গর্ত পেলেও লুকিয়ে পড়া যায়।
ভাগ্য ভাল বলতে হবে, দুটোই পেল একসঙ্গে। চ্যাপ্টা একটা পাথর কাত হয়ে আছে, একদিকে সামান্য উঁচু, তার নিচে পেয়ালা আকৃতির ছোট একটা গর্ত। কোনমতে জায়গা হবে শরীরটার। আর কোন বিকল্প নেই। ওর মধ্যে শরীর ঢুকিয়ে দিল সে। মাথা রইল এক পাড়ে ঠেকে, অন্য পাড়ে পা। পেছনটা গর্তের তলায়। মাটি গরম, মরুর ঠাণ্ডা রাতে বেশ আরাম লাগল এই উষ্ণতায়। তাপমাত্রার কি দ্রুত ওঠানামা এসব অঞ্চলে, ভাবলে অবাক লাগে। এই তো, খানিক আগে গরমে কম্বলের নিচ থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে হাঁসফাঁস করছিল, আর এরই মধ্যে আবহাওয়া এতটাই শীতল হয়ে গেল, গরম এখন ভাল লাগছে।
ওকে গরুখোঁজা খুঁজছে তিনজন লোক। তাদের চেঁচামেচি আর নানারকম আওয়াজ স্পষ্ট কানে আসছে। তারপর হঠাৎ সব নীরব হয়ে গেল। বড় বেশি নীরব। কিছু একটা ঘটেছে।
আস্তে মাথা তুলল মুসা। কানে এল ঘোড়ার নালের খটাখট আর কুকুরের ঘেউ ঘেউ। তার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকল কেউ।
কিশোর! লাফ দিয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়ল মুসা। ছুটল আবার ঝোঁপের ভেতর দিয়ে।
সবাই এসেছে। কিশোর, রবিন, জিনা, টনি, মিস্টার ডিউক, শেরিফ, সব্বাই। টাইগারও রয়েছে ওদের সঙ্গে। কুকুরটা আগে এগিয়ে এল। লেজ নাড়তে নাড়তে চেটে দিল মুসার হাত। তাতে মন ভরল না, লাফিয়ে উঠে তার বুকে দুই পা তুলে দিয়ে গাল-নাক চাটতে শুরু করল।
আরে, থাম, থাম, আলতো ধাক্কা দিয়ে টাইগারের মুখ সরিয়ে দিল মুসা।
টনি, মিস্টার ডিউক আর শেরিফ গিয়ে ঘিরে ধরল তিন অপরাধীকে। টনির হাতে রাইফেল, শেরিফের হাতে পিস্তল।
বাঁধুন ওদের, চেঁচিয়ে বলল মুসা। পালাতে দেবেন না। যত নষ্টের মূল এই তিন ব্যাটা।
জানি, বলল কিশোর। ঘণ্টাখানেক আগে রিসোর্টে পৌচেছে। জুলিয়ান। তোমার বিপদের কথা জানাল। শেরিফকে ফোন করলাম। তারপর ছুটে এলাম এখানে।
জুলিয়ান কই?
পাহাড়ের ওপাশে, হাত তুলে দেখাল রবিন। ঘোড়াগুলো পাহারা দিচ্ছে।
শেরিফ জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছিল, মুসা?
এটা রিসোর্টের এলাকা না? পাল্টা প্রশ্ন করল মুসা।
হ্যাঁ।
তাহলে অনেকগুলো অপরাধের অভিযোগে এদের গ্রেপ্তার করতে পারেন আপনি। অনধিকার চর্চা থেকে খুনের চেষ্টা, সবই করেছে ওরা এখানে। চুরি-চামারিও করেছে।
সমস্ত প্রমাণ স্বচক্ষে দেখল শেরিফ। আর কোন আশা নেই দেখে অপরাধ স্বীকার করল ডাক্তার জিংম্যান। জানাল, জুলিয়ানকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যেই ওরা নানারকম অন্যায় করে সেই দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। জুলিয়ানের ওপর মিস্টার উইলসনকে খেপিয়ে তোলার জন্যে বাংলোতেও আগুন দিয়েছে রিকি, অবশ্যই বসের নির্দেশে।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, ওটাই আসল লস্ট ডাচম্যান মাইন, তাই না?
হ্যাঁ, ওখানেই কোথাও আছে খনিটা, জবাব দিল টনি। ভালমত খুঁজলে বেরিয়ে পড়বে।
সোনা আছে?
থাকতে পারে। সে সম্ভাবনা আছে বলেই ঝুঁকি নিয়ে এত সব কুকর্ম করেছে ওরা, জিংম্যান আর তার দুই সহকারীকে দেখাল টনি।
এ-ব্যাপারে কিছু বলার আছে? জিংম্যানকে জিজ্ঞেস করল শেরিফ।
কি আর বলব, হতাশ কণ্ঠে বলল ডাক্তার। পাইনি কিছু। তবে। এখানেই আছে কোথাও। গত বছর দুটো নুড়ি পেয়েছিলাম, বেশ বড়। বুঝলাম, আছে কিছু এখানে। সেজন্যেই কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আরও আগেই যদি জানতাম, তাহলে কি আর উইলসন এত দূর থেকে এসে দখল করতে পারে? আমিই তো তার আগে কিনে নিতাম।
যদি সোনা না থাকে? শিওর তো না, বলল জিনা।
তাতে কি? জায়গাটার আসল দামই দিতে চেয়েছিলাম। ঠকা হত না আমার।
জুলিয়ান না কি যেন নাম, ছেলেটার পিছে লাগা হলো কেন? জিজ্ঞেস করল শেরিফ।
আমার এই দুই গর্দভ করেছে সর্বনাশটা। ওদেরকে কতবার বলেছি, হুশিয়ার হয়ে কাজ করতে, রিসোর্টের লোকজনের ওপর চোখ রাখতে, কানই দেয়নি। ওদেরকে এখানে খুঁড়তে দেখে ফেলেছিল ছেলেটা।
দেখলে কি হয়েছে? প্রশ্ন করল কিশোর।
গিয়ে বলে দিতে পারত আমরা এখানে সোনার খোঁজ করছি। সে যাতে কিছু বলে কাউকে বিশ্বাস করাতে না পারে, সে চেষ্টা করা হয়েছে।
এখান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে, না? এক ঘুসিতে জিংম্যানের দাঁত কয়টা ফেলে দেয়ার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করলেন শিক্ষক।