তারপর এসে একটা টুলে বসে ভাবতে লাগল, কিন্তু বেরোনোর কোন উপায় দেখল না।
তাহলে এ ঘরেই কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে। ছোট্ট ঘর। লুকানোর জায়গা নেই। কয়েকটা কম্বল অবহেলায় স্কুপ হয়ে পড়ে আছে। এককোণে। আশা হলো তার। ওগুলোর নিচে লুকালে হয়তো চোখে পড়বে না কারও। লুকিয়ে থাকবে, তারপর লোকগুলো ঘুমিয়ে পড়লে কোন এক সুযোগে বেরিয়ে যেতে পারবে।
লুকানোর জায়গার মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে জানালার কাছে ফিরে এল মুসা। দু-জনের কাজ দেখতে লাগল বসে বসে। আর কিছু করার নেই। অলস ভঙ্গিতে পাহাড়ের গা খুঁচিয়ে চলেছে ওরা। সোনা! হ্যাঁ, এখানকার সমস্ত গোলমালের মূলে ওই সোনার খনি।
ডাক্তার জিংম্যানের নামটা বার বার ঘুরেফিরে আসছে মনে। মিস্টার উইলসনের সম্পত্তি কেন কিনতে চেয়েছিল সে, এখন বোঝা যাচ্ছে।
এক ঘণ্টা কাটল, আরও এক ঘণ্টা। খোঁড়ায় বিরাম নেই রিকি আর পেকের। মাঝে মাঝে একটা পুরানো মেসকিটের ছায়ায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। গাছটার পাশেই ছোট একটা ঝর্না। তৃষ্ণার্ত চোখে ওটার দিকে তাকাচ্ছে মুসা। গরমে, বদ্ধ এই নোংরা ঘরে বসে থেকে থেকে ভয়ানক তেষ্টা পেয়েছে তার। গলা শুকিয়ে কাঠ।
সূর্য অস্ত যাওয়ার আগের ক্ষণে লম্বা লম্বা ছায়া পড়ল উপত্যকায়। কাজ থামাল লোকগুলো। শাবল-বেলচা ফেলে দিয়ে পা বাড়াল কেবিনের দিকে।
দুরুদুরু করতে লাগল মুসার বুক। তাড়াতাড়ি উঠে এগোল লুকিয়ে পড়ার জন্যে।
কম্বলের তলায় অন্ধকারে ঢুকে গেল।
ঘরে ঢুকল দুই প্রসপেক্টর। খাবারের টিন খুলতে খুলতে আলোচনা চালাল। বেশির ভাগই জুলিয়ানের কথা। ওরা অসতর্ক থেকেছে বলে বস যে ভীষণ বকবে, সেজন্যে অস্বস্তি বোধ করছে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে মুসার, এই গরমে কম্বলের মধ্যে থাকাটা এক ভয়ানক অস্বস্তির ব্যাপার। আর যখন পারে না সে, অসহ্য হয়ে উঠেছে, তখন বেরোল লোকগুলো। সঙ্গে সঙ্গে একদিক ফাঁক করে নাকমুখ বের করে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
বাইরে আগুন জ্বালানোর শব্দ। রান্নার ব্যবস্থা হচ্ছে। একটু পরেই শিকে গাঁথা ঝলসানো মাংসের সুগন্ধ এসে কেবিনেও ঢুকল। জিভে পানি এসে গেল মুসার, মোচড় দিয়ে উঠল পেটের ভেতর। দুপুরে প্রায় কিছুই খায়নি, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। কিন্তু করবেটা কি? বাইরে অবশ্য এখন অন্ধকার, কিন্তু তবু বেরোতে পারবে না, চোখে পড়ে যাবেই। দরজার কাছেই বসেছে ওরা।
কম্বলের তলায় অসহ্য লাগছে। ঘামছে। বেরিয়ে হাত-পা ঝাড়া দেয়ার লোভটা সামলাতে পারল না। আর বেরোতে গিয়েই বাধাল বিপত্তি। তার রাইডিং বুটে বেধে গেল কম্বলের ভেঁড়া একটা জায়গা, খেয়াল করল না সে। লাগল হ্যাঁচকা টান। হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ল একটা চারপায়ার ওপর। দড়াম করে পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে পড়ল চারপায়াটা।
সঙ্গে সঙ্গে হই-চই শোনা গেল বাইরে। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল। দরজা।
দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল মুসা।
লণ্ঠন হাতে ঢুকল একজন। দেখে ফেলল মুসাকে।
রিকি, হাসি হাসি গলায় পেঁচিয়ে ডাকল পেক, দেখে যাও এসে। একটা ছুঁচো।
মেরে ফেলল। মাড়িয়ে দাও পা দিয়ে…
আরে, ওই ছুচো না, মানুষ ছুঁচো। জলদি এসো।
পিকচুকল। বাহার। ঘরে ঢুকতম প্রতিবেশী এবং হুম। তো,
কঙ্কার জিংম্যান। উইহকারী না এটা তো চিঠিকে
কথা শেষ হলো না তার। ঘরে ঢুকল আরেকজন। ডাক্তার জিংম্যান! উইলসনের নিকটতম প্রতিবেশী এবং বন্ধু।
পিচ্চি হোমসটার সহকারী না এটা? বলল ডাক্তার। হুম। তো, মিয়া, এখানে কি মনে করে? তোমার দোস্ত তো চিঠিকেও কেয়ার করল না, বিছেকেও ভয় পেল না। সাহস থাকা ভাল। তবে বেশি সাহস…
তিন বিচ্ছুর একটা নাকি এটা, বস? জিজ্ঞেস করল রিকি।
আবার জিজ্ঞেস করে, গাধা কোথাকার! চেনো না? তীর ছোঁড়ার সময় কি চোখ বুজে ছিলে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এটাই তো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। অন্য দুটোকে। নইলে সেদিন পালের গোদাটা যেত। না মরলেও আধমরা তো হতই।
হতে তো কত কিছুই পারত, কম সুযোগ মিস করেছ? এটা করলে ওটা করলে, সব ফুস আর ফাস! নালায় টেনে আনলে, এত নিরালা জায়গা, একলা পেলে, তা-ও কিছু করতে পারলে না, কর্কশ শোনাল জিংম্যানের কণ্ঠ।
সেটা কি আমার দোষ? পানি আসা পর্যন্ত থাকলই না, উঠে চলে গেল।
যাতে না যেতে পারে সেরকম ব্যবস্থা করতে পারতে।
এত অভিযোগ শুনতে ভাল লাগল না রিকির, সে-ও রেগে গেল। আমাকে একা বলো কেন? সুযোগ তো তুমিও পেয়েছ। ধাক্কা দিতে গিয়েছিলে গাড়িকে, পেরেছ? ঠিক নেমে চলে গেল পথের পাশে…
দূর, বিরক্ত হয়ে হাত নাড়ল পেক, শুরু করল ঝগড়া! অহেতুক তর্ক না করে এটাকে কি করব, তাই বলো।
ভুরু কুঁচকে ভাবল এক মুহূর্ত জিংম্যান। আপাতত হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে। পরে ভেবেচিন্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটানো যাবে। ঢুকে যখন পড়েছে, বেরোতে আর দিই কি করে? মুসার হাত চেপে ধরল সে। সহকারীদের বলল, দড়ি আনো।
লম্বা শ্বাস টানল মুসা। অপেক্ষা করছে। আড়চোখে দেখল, দরজার কাছ থেকে সরে আসছে পেক। দড়ি আনতে ঘরের কোণে গেল রিকি। এই-ই সুযোগ। চোখের পলকে বুট তুলে গায়ের জোরে লাথি মারল ডাক্তারের বা পায়ের হাটুর ওপর।
আঁউ! করে উঠল ডাক্তার। ঢিলে হয়ে গেল আঙুল।
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল মুসা। মাথা নিচু করে ছুটে গেল পেকের পেট সই করে। তার নিগ্রো-খুলির বদনাম আছে। রবিন তো বলে, তার মাথায় আছড়ে পাকা নারকেল ভাঙা যায়, এত শক্ত। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। তার মাথার গুতো যে একবার খেয়েছে, সহজে ভুলবে না।