জুলিয়ানের দেখাদেখি মুসাও তার ঘোড়া বাঁধল গোল উপত্যকায়। পিছু নিল।
চূড়ায় উঠে ফিরে তাকাল জুলিয়ান। ঠোঁটে আঙুল রেখে কোনরকম শব্দ না করতে ইশারা করল মুসাকে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।
মানুষের কণ্ঠ কানে এল মুসার। ওপাশে নিচে কারা যেন কথা বলছে। শাবল-কোদালের আওয়াজ। মাটি খুঁড়ছে মনে হয়।
চোদ্দ
এক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকল মুসা, তারপর বাকি কয়েক ফুট প্রায় ছুটে পেরোল। চূড়ায় এসে হুমড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ল জুলিয়ানের পাশে।
নিচে একটা গিরিখাদ। বড় বড় পাথরের চাঙড় পড়ে রয়েছে। ঝোঁপঝাড় আর গাছপালা এত ঘন, ভাল করে না তাকালে খাদটা চোখে পড়ে না।
দু-জন লোক কথা বলছে আর কাজ করছে। একজন লম্বা, লালচে চুল। অন্যজন তার চেয়ে বেঁটে, কালো চুল। গিরিখাদের এক দিকের দেয়াল খুঁজছে ওরা। আরেক দিকে খানিকটা উঁচুতে খোলামত জায়গায় একটা কাঠের কেবিন।
ওদের একটা ঘোড়া দেখে চমকে গেল মুসা। সাদা-কালো পিন্টো, অবিকল জুলিয়ানের ঘোড়াটার মত দেখতে।
নীরবে পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। আবার চোখ ফেরাল খাদের দিকে। কয়েক মিনিট দেখে জুলিয়ানকে ইশারা করল মুসা, সরে আসার জন্যে। এপাশে কয়েক ফুট নেমে এল, কথা বললে যেন লোকগুলো শুনতে না পায়।
কে ওরা? নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল মুসা।
বোধহয় প্রসপেক্টরস।
রিসোর্ট এলাকার মধ্যে? জুলিয়ানও অবাক হলো।
চারপাশে তাকিয়ে দেখল মুসা। ল্যাণ্ডমার্ক দেখা যায়। প্রথম যেদিন টনি আর জিনার সঙ্গে বেরিয়েছিল, সেদিন ওই চিহ্ন চিনিয়েছে ওরা।
হ্যাঁ, রিসোর্ট এলাকা। ওই যে চূড়াটা, ওখান পর্যন্ত সীমানা।
সোনা খুঁজছে বোধহয় ব্যাটারা, ক্লান্ত হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল জুলিয়ানের ঠোঁটে। পেলে তো একটা কাজের কাজই করে ফেলবে।
আগে কখনও ওদেরকে দেখেছ এখানে?
নার্ভাস ভঙ্গিতে নড়ল জুলিয়ান, চোখ সরিয়ে নিল। ঘুরিয়ে জবাব দিল, দেখতে এসেছি কয়েকবার।
ওরা দেখেছে তোমাকে? কিছু গোপন করছে জুলিয়ান, বুঝতে পারল মুসা।
এক মুহূর্ত চুপ করে রইল জুলিয়ান। একবার। এখানে না। ওদিকে আরেকটা উপত্যকা আছে, চারপাশে পাহাড়, ওখানে। ঘোড়া নিয়েই নামলাম, দেখতে গেলাম কি করছে। রেগে গেল ওরা, লম্বুটা তো গুলিই করে বসল। সরে গেছি আগেই, তাই লাগেনি। তারপর বেশ কিছুদিন আর যাইনি ওদিকে।
গুলি করেছে? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা।
মাথা ঝাঁকাল জুলিয়ান। আমি কিছু করিনি। খালি দেখতে গিয়েছিলাম, কসম।
আমি বিশ্বাস করছি তোমার কথা। ওদিকেও কি সোনাই খুঁজছিল?
আবার মাথা ঝাঁকাল জুলিয়ান। প্রসপেক্টররা পাহাড়ে যা করে, তা-ই করছিল। বহুবার লুকিয়ে দেখেছি।
চুপ করে কিছু ভাবল মুসা। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল, আজ কোথায় যাচ্ছিলে? কাউকে কিছু না বলে চুরি করে যে পালিয়ে এলে?
পাতলা চোয়ালদুটো দৃঢ়বদ্ধ হলো। আবার সরিয়ে নিল চোখ। ঘুরতে যাচ্ছিলাম।
চুপ করে রইল মুসা। অপেক্ষা করছে।
পালিয়ে যাচ্ছিলাম, অবশেষে স্বীকার করল জুলিয়ান। আর। ফিরে যাব না রিসোর্টে।
সেটা কি ঠিক হবে? তোমার ফুপা-ফুপুর কথা ভাবলে না। ওরা তোমাকে কত ভালবাসে।
ফুপা আমাকে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেবে। ভাবছে, আমি চোর। শেরিফ বলেছে, আমি খুব খারাপ ছেলে। কসম খেয়ে বলেছি, আমি চুরি করিনি। কোত্থেকে ফিরিয়ে দেব? বড় বড় চোখ দুটোতে অশ্রু টলমল করে উঠল। হয়তো পিন্টোকেও কেড়ে নেবে আমার কাছ থেকে। এসব তো অন্যায়। ওকে কেন কেড়ে নেবে আমার কাছ থেকে, বলো? ও তো আমার, চুরি করে আনিনি।
ছেলেটার দুঃখ বুঝতে পারছে মুসা। কিন্তু পালিয়ে যে যেতে চাইছ, এতে তো সন্দেহ আরও বাড়বে ওদের। কদ্দিন ওদের চোখ এড়িয়ে বাঁচতে পারবে?
চুপ করে রইল জুলিয়ান। জবাব দিতে পারল না।
এই প্রসঙ্গ বাদ দিল মুসা। জানাল, আগের রাতে কি ঘটেছে, কি করে আরেকটা পিন্টো ঘোড়াকে অনুসরণ করে নালায় গিয়ে মরতে বসেছিল কিশোর।
গিরিখাদের পিন্টোটার কথা উল্লেখ করে জুলিয়ান বলল, বোধহয় ওটাই।
হাসল মুসা। আমারও তাই ধারণা। আচ্ছা, এখান থেকে কোথাও যায় না ওরা? সরে না?
সরে। কেন?
ওই কেবিনটায় ঢুকে দেখতে চাই। সব গোলমালের মূলে ওরা হলে, ওখানে কিছু সূত্র পাবই। আমি না বুঝলেও, কিশোরকে বললে বুঝবে, কেন তোমাকে ফাসাতে চাইছে ওরা।
এক কাজ করলেই পারি, দুষ্টু হাসি ফুটল জুলিয়ানের ভেজা চোখের তারায়। আমাকে তাড়া করুক ওরা। এই সুযোগে তুমি নেমে ঢুকে পড়ো কেবিনে।
মাথা নাড়ল মুসা। ভীষণ রিস্কি হয়ে যাবে.. কথা শেষ করতে পারল না সে, তার আগেই ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে জুলিয়ান।
বাধা দেয়ার সুযোগই পেল না মুসা। এক লাফে ঘোড়ায় চড়ে ছুটল জুলিয়ান। এদিকে ফিরে হেসে হাত নাড়ল।
এ দ্বিধা করছে মুসা। কেবিনে ঢুকতে তাকে বাধ্য করল জুলিয়ান। মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে সে, এখন আর পিছিয়ে আসা চলবে না মুসার।
আর জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল মুসা, আবার উঠে এল চূড়ায়। উপুড় হয়ে শুয়ে তাকিয়ে রইল নিচের দিকে।
গিরিপথের মত একটা জায়গা দিয়ে ঢুকতে হয় গিরিখাদে। পথের মুখে দেখা দিল জুলিয়ান। কেউ দেখল না তাকে। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে চেঁচিয়ে উঠল সে। কি বলল, স্পষ্ট বোঝা গেল না দূর থেকে। তবে চোর আর সোনা এই দুটো শব্দ কানে এল।