বিদ্যুৎ চমকালে মনে হলো যেন দুপুরের আলো। স্পষ্ট চোখে পড়ল সামনের সব কিছু। সামনে নালার দুই পাড় এখানকার চেয়ে অনেক বেশি খাড়া। দুই পাশেই পাহাড়ের ঢাল, তা-ও যথেষ্ট খাড়া।
বৃষ্টি আরও বাড়ল। সামনে এগিয়ে আর লাভ হবে না, পিন্টোটাকে হারিয়েছে। হতাশ হয়ে ঘোড়াকে ওটার ইচ্ছেমত চলতে দিল সে।
গেল কোথায় পিন্টো? গভীর নালা থেকে হঠাৎ করে একেবারে উধাও তো হয়ে যেতে পারে না। ধারেকাছেই লুকিয়ে আছে কোথাও?
ছিল তো এখানেই, বিড়বিড় করে ঘোড়াটার সঙ্গে কথা বলল কিশোর। ঠিকই অনুসরণ করেছিস। তারপর?
কিশোরের কথার জবাবেই বুঝি আরেকবার ফোঁস করে উঠল ঘোড়া। হঠাৎ যেন হোঁচট খেয়ে থেমে গেল। বাঁকা হয়ে গেল পেছনদিকে। কাদামাটিতে নাল ঢুকিয়ে দিয়ে পতন রোধ করতে চাইছে। সামনে ঢাল, তারপরে তরাই।
অনেক কষ্টে পিছলে পড়া থেকে রেহাই পেল ঘোড়াটা। হাঁপ ছাড়তে যাবে এই সময় কিশোরের কানে এল একটা অদ্ভুত গমগমে আওয়াজ। বজ্রপাতের নয়। তুমুল বৃষ্টিতে ভরে গেছে নালা। পেছনে তাকিয়ে দেখল কিশোর, দুই পাড় উপচে ভয়ঙ্কর গতিতে ছুটে আসছে পানি, ভাসিয়ে আনছে ঝড়ে উপড়ানো গাছপালা ঝোঁপঝাড়।
বারো
প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে কিশোরের নির্দেশ ছাড়াই খাড়া পাড় বেয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করল ঘোড়াটা। মরিয়া হয়ে উঠল। পিছল মাটি, ভিজে আলগা হয়ে আছে ওপরের অংশ। নাল গাঁথতে চাইছে না তাতে, আর গাঁথলেও খসে যাচ্ছে আলগা মাটি। বাশ বেয়ে ওঠা সেই শামুকের অবস্থা হয়েছে যেন, দুই ফুট ওঠে তো দেড় ফুট নামে।
এসে গেছে পানি। শেষ চেষ্টা বল ঘোড়াটা। পেছনের দুই পা মাটিতে গেঁথে প্রায় লাফ দিয়ে পড়ল সামনে। সামনের দুই পা পাড়ের। ওপরের মাটিতে ঠেকলে আরেক ঝাঁকিতে শরীরটা তুলে আনল ওপরে। প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রইল কিশোর। আরেকটু হলে গিয়েছিল পিঠ থেকে পড়ে।
হুড়মুড় করে নিচ দিয়ে চলে যাচ্ছে পানি। তাতে পড়লে আর রক্ষা ছিল না। উড়ে গিয়ে পড়তে হত নিচে।
থরথর করে কাঁপছে ঘোড়া আর মানুষ, কে যে বেশি কাঁপছে বোঝা মুশকিল। ঘোড়ার গলায় গাল চেপে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে কিশোর।
নাক নামিয়ে নিজের দুই হাঁটু শুকল ঘোড়া, কেন কে জানে। ব্যথা করছে বোধহয়, কিংবা কিছু একটা হয়েছে। পাহাড়ের ঢাল আর নালার পাড়ের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
র্যাঞ্চটা কোন্দিকে কতদূরে আছে জানে না কিশোর, ঘোড়ার ওপরই এখন ভরসা। পথ চিনে যদি বাড়ি ফিরতে পারে। কিন্তু এই অন্ধকারে ঝড়ের মাঝে চিনবে তো?
চলছে তো চলছেই, পথের যেন আর শেষ নেই। কিশোরের মনে হলো, কয়েক যুগ পর যেন হঠাৎ করে থেমে গেল বর্ষণ। পিঠে ভারি ফোঁটার অনবরত আঘাত কমে আসতে মাথা তুলল সে। ভিজে সপসপ করছে কাপড়, গায়ের সঙ্গে মিশে গেছে। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস তীক্ষ্ণ সুচের মত মাংস ভেদ করে গিয়ে লাগছে যেন একেবারে হাড়ে। অবাক হয়ে দেখল, দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে আকাশ, ইতিমধ্যেই পেছনে হয়ে। গেছে অনেকখানি। মখমলের মত কালো আকাশে উজ্জ্বল তারা ঝকমক, করছে। মেঘের নামগন্ধও নেই। এসব অঞ্চলের ঝড়বৃষ্টিই এমন, এই আর্সে এই যায়।
পাহাড়ের মোড় ঘুরতেই সামনে আলো দেখা গেল, গাড়ির হেডলাইট এদিকেই আসছে। কাছে এসে ব্রেক কষল। রিসোর্টের পুরানো একটা জীপ। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে আগে নামল টাইগার। ঘোড়র কাছে এসে ঘেউ ঘেউ আর নাচানাচি জুড়ে দিল। ছুঁতে চাইছে। কিশোরকে।
কিশোর! লাফিয়ে বেরোল মুসা। আল্লাহকে হাজার শোকর, পেলাম তোমাকে! আমরা তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। কোথায় গিয়েছিলে? কি হয়েছিল?
একে একে নামল রবিন, জিনা, টনি।
কিশোরকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামাল টনি। ঘোড়ার পেছনে চাপড় দিয়ে বলল, বাড়ি যা। অনেক কষ্ট করেছিস!
চলতে শুরু করল ঘোড়াটা।
পিন্টোটাকে নিয়ে জুলিয়ান যে কোথায় গায়েব হলো, কিশোর বলল, কিছুই বুঝলাম না।
জুলিয়ান? জিনা অবাক। ঘরেই তো দেখে এলাম ওকে। বিকেল থেকেই আছে। ওর ঘোড়াটাও আস্তাবলে। খটখটে শুকনো। শুধু তুমি যেটাকে এনেছ সেটাকেই পাওয়া যাচ্ছিল না।
কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখলাম পিন্টোতে চড়ে যাচ্ছে, জোর প্রতিবাদ করল কিশোর। আমার সামনে সামনেই এগোল। তারপর নালার মাথা থেকে উধাও। নিচে তরাইয়েই পড়ে গেল কিনা কে জানে।
সত্যি দেখেছ? টনি জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চয়ই।
জুলিয়ানকে?
থমকে গেল কিশোর। ঢোক গিলল। চেহারা তো দেখিনি… অনিশ্চিত কণ্ঠস্বর। তাই তো, এ যে আরেকটা ফাঁদ, ভাবিনি তো! কিন্তু কি করে জানল সে আমি ওকে অনুসরণ করব?
হয়তো একটা চান্স নিয়েছে, রবিন বলল।
তোমাকে দেখিয়ে আস্তাবল থেকে বেরিয়েছে। পিন্টো দেখে যদি পিছু নাও, এই আশায়। এবং তার ফাঁদে পা দিয়েছ তুমি।
হ্যাঁ, তা ঠিক, খানিক আগের তুফানের মতই চালু হয়ে গেছে কিশোরের ব্রেন। আমি অনুসরণ করলে, সে আমাকে নিয়ে গেছে এমন এক জায়গায়, যেখানে অন্ধকারে পড়ে মরব। কেউ কিছু সন্দেহ করত না। সবাই ভারত, একটা দুর্ঘটনা।
বাঁচিয়েছে তোমাকে ফ্রান্সিস, ঘোড়াটার কথা বলল টনি। সবচেয়ে ভালটাকেই বেছেছিলে। কয়েকবার ও আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
ভেজা উঁচুনিচু পথ ধরে ঝাঁকুনি খেতে খেতে ছুটে চলেছে পুরানো জীপ। কিশোর একেবারে চুপ, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে। অন্যরাও চুপ করে রইল।