হেসে ফেলল জিনা। আমি খুব বদমেজাজী, না? তাই তো এবার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তোমাদের কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না।
কোন দরকার নেই, মিটিমিটি হাসছে রবিন। রাগ না থাকলে আসল জিনাকে হারাব আমরা। ভদ্র মিস জরজিনা পারকারকে চাই না, আমাদের জিনাকেই দরকার। তোমার যত খুশি দুর্ব্যবহার করো, মেজাজ দেখাও, কিছু মনে করব না।
তোমরা চেনো বলে…
যারা চেনে না তাদেরকেও বলে দেব, তোমার স্বভাবই ওরকম। বাইরে তুমি রুক্ষ হলেও ভেতরে তোমার অত্যন্ত কোমল সুন্দর একটা মন আছে। আসলে তুমি খুব ভাল মেয়ে।
হয়েছে হয়েছে, আর তেলাতে হবে না, কৃত্রিম মুখঝামটা দিল জিনা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এত খুশি হয়েছে, রিঙের সঙ্গে ছোট্ট শেকলে ক্যাচিনা পুতুল ঝোলানো তিনটে চাবির রিঙ কিনে ওখানেই উপহার দিয়ে ফেলল তিনজনকে।
যাক, মাঝেসাঝে ঝগড়া বাধালে লাভই, বলল মুসা।
চেনটা আবার তুমি পরো, জিনা, প্লীজ।
কি ভেবে আবার চেনটা পরল জিনা।
সত্যি, চমৎকার মানিয়েছে, বলল ইনডিয়ান সেলসগার্ল, এতক্ষণ উপভোগ করছিল ছেলেমেয়েদের ঝগড়া। কাপড়-চোপড় ঠিকমত পরালে একেবারে ইনডিয়ান বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।
চুল যে তামাটে?
তাতে কি? কালো করে নিলেই হবে।
তা রাগ অভিমান তো অনেক হলো, হাত তুলল কিশোর। বাড়ি টাড়ি কি যাব আমরা?
ইনডিয়ান মেয়েটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দোকান থেকে বেরোল ওরা।
শেষ বিকেলে র্যাঞ্চে ফিরল।
গত দু-দিন ধরে নতুন কিছু না ঘটায় কিছুটা হতাশই হয়েছে। কিশোর। জাংশন থেকে ফেরার পথে রহস্যগুলোর কথা খালি ভেবেছে। দু-রাত ধরে কাচিনা ভূতটারও দেখা নেই।
ব্যাপারগুলো এতই খচখচ করছে মনে, পেট ভরে খেতে পারল না রাতে। তাস খেলার প্রস্তাব দিল টনি, রাজি হলো না সে। মুসা আর রবিনকে নিয়ে খেলতে বসল টনি, জিনাও এসে যোগ দিল। কয়েক মিনিট খেলা দেখে উঠে পড়ল কিশোর। চলে এল বড় হলরুমটায়, যেখানে ক্যাচিনা পেইন্টিংগুলো রয়েছে। কি এক অদৃশ্য আকর্ষণ যেন তাকে টেনে নিয়ে এল, সেই মেঘ-ক্যাচিনাটার কাছে, যেটায় ভূত ঢুকে পড়েছে বলে মনে হয়েছিল সেদিন।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল কিছুক্ষণ। ব্যতিক্রমী কিছু চোখে পড়ল না। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল।
আকাশের কোণে মেঘ, বৃষ্টির আগমন সঙ্কেতে যেন বাতাস উত্তেজিত।
কালো আকাশ চিরে দিল নীলাভ বিদ্যুৎ, সুপারস্টিশনের উঁচু চূড়া প্রায় ছুঁয়ে তীব্র গতিতে ছুটে হারিয়ে গেল ওপাশে।
থমথমে প্রকৃতিতে আলোড়ন তুলল ভেজা ঝড়ো বাতাস। দোল খেলে গেল জানালা-দরজার সাদা পর্দায়। বহুদূরে, পর্বতের দিক থেকে ভেসে এল বজ্রপাতের চাপা গুমগুম। এরই মাঝে শোনা গেল ঘোড়ার খুরের শব্দ। আবছা আলোয় চকিতের জন্যে ঘোড়াটা চোখে পড়ল কিশোরের, ছুটে চলে যাচ্ছে-সাদা-কালো পিন্টো ঘোড়া।
মুহূর্ত দ্বিধা করেই দরজার দিকে দৌড় দিল কিশোর। বাইরে বেরিয়ে ছুটল আস্তাবলের দিকে। তুফান আসছে, এর মাঝে এই অন্ধকারে কোথায় যাচ্ছে জুলিয়ান? দেখতেই হবে। অন্য কাউকে কিছু বলে আসার সময় নেই।
অন্ধকারে, আস্তাবলের ভেতরে কিছু দেখা যায় না। দরজার ঠিক ভেতরের স্টলে যে ঘোড়াটা পেল, তাতেই চড়ে বসল। বের করে নিয়ে এল। আবছা অন্ধকারে যতখানি সম্ভব জোরে ছুটে অনুসরণ করে চলল সামনের ঘোড়াটাকে।
উপত্যকায় পৌঁছে শুকনো একটা চওড়া নালার মধ্য দিয়ে ছুটল ঘোড়া। গতি কমিয়ে সামনের ঘোড়াটা খুঁজল কিশোর, দেখল না। তারপর হঠাৎই আবার চোখে পড়ল সাদা-কালো ঝিলিক, ক্ষণিকের জন্যে। ওটাও ছুটছে নালা দিয়ে।
জুলিয়ান, শোনো! চিৎকার করে ডাকল কিশোর। জুলিয়ান!
জবাবে শুধু ঘোড়ার খুরের শব্দ।
বাতাসের বেগ বাড়ছে, ধুলো উড়ছে। তার সঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে শুকনো পাতা আর কুটো। পড়ছে এসে চোখেমুখে, চোখ খুলে রাখা দায়। খুরের শব্দ শুনে শুনে অনেকটা অন্ধের মত ঘোড়া নিয়ে এগোচ্ছে কিশোর।
বজ্রপাতের গর্জন জোরাল হচ্ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘনঘন। অনেক সামনে ঘোড়াটাকে ক্ষণে ক্ষণে চোখে পড়ছে সেই আলোয়। আরও কয়েকবার ডাকল কিশোর, কিন্তু সাড়া দিল না পিন্টোর সওয়ারী, ফিরেও তাকাল না।
নামল বৃষ্টি। বাজ পড়ল প্রচণ্ড শব্দে, দু-ভাগ হয়ে গেল যেন আকাশটা। মুষলধারে বৃষ্টি, ফোঁটা ফোঁটা নয়, যেন পানির চাদর। থেমে যাচ্ছে ঘোড়াটা বারবার, খোৎ-খোৎ করছে, মাথা ঝাড়ছে। এই
ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সামনে এগোতে রাজি নয় সে, ফিরে যেতে চায়। আস্তাবলের নিরাপদ শুকনো আশ্রয়ে।
ঘোড়াটাকে হাঁটতে বাধ্য করল কিশোর। রেকাবে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাল, পানির চাদর ফুড়ে অন্ধকারে কয়েক হাতও এগোল না নজর। পিন্টোটাকে দেখা গেল না। খুরের আওয়াজও আর শোনা যাচ্ছে না এখন। ভয়ানক অস্বস্তিতে পড়ে গেল সে। নালা ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল পর্বতের আরও ভেতরে।
থেমে থেমে যাচ্ছে ঘোড়াটা। চলতে খুব অসুবিধে হচ্ছে। তোড়ে নেমে আসছে পানি, শুকনো মাটি এখন পিচ্ছিল কাদা। আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাল। সামনের দৃশ্য দেখে কিশোরও চমকে গেল।
সামনে নালাটা মনে হলো শেষ। পিন্টো আর তার সওয়ারী অদৃশ্য। গেল কোথায়!
রাশ টেনে ঘোড়া থামিয়ে পরবর্তী বিদ্যুৎ চমকের অপেক্ষায় রইল কিশোর। ইস, বোকামি হয়ে গেছে। তাড়াহুড়োয় টর্চ আনতে মনে ছিল না।