হোপি ইনডিয়ান আর আরও কয়েকটা ইনডিয়ান উপজাতির ধর্মে রয়েছে ক্যাচিনার উপাখ্যান। পুতুলগুলো আসলে ইনডিয়ানদের কল্পিত প্রেতাত্মার প্রতিমূর্তি। বাস্তব-অবাস্তব জিনিস আর জীবের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি হয়েছে ওগুলো। ক্যাচিনা নানারকম আছে, যেমন, মেঘ-ক্যাচিনা, জন্তু-ক্যাচিনা, উদ্ভিদ আর পাখি-ক্যাচিনা। কল্পিত ভয়াবহ দৈত্যদানবের ক্যাচিনাও আছে অনেক।
জরুরী যা যা জানার, কিশোরের কথামত বই পড়ে সব জেনে নিল রবিন। কিন্তু বইয়ের কোথাও কাচিনার অভিশাপের কথা লেখা নেই। কিচ্ছু না।
যাত্রার আগের দিন আরেকটা চিঠি এল কিশোরের নামে।
অ্যারিজোনা থেকেই! ভুরু কোঁচকাল কিশোর। খাম ছিঁড়ে চিঠি খুলল। কাগজের কোনায় বড় করে একটা ক্যাচিনা পুতুল আঁকা, পিঠে তীর বিদ্ধ। তার তলায় কয়েকটা শব্দ, খবরের কাগজ কেটে অক্ষরগুলো নিয়ে আঠা দিয়ে পর পর সেঁটে দেয়া হয়েছে, দাড়ি-কমা কিছু নেই:
কিশোর পাশা
অ্যারিজোনা থেকে দূরে থাকবে।
দুই
এয়ারপোর্ট টারমিনাল বিল্ডিঙ থেকে বেরোতেই যেন মুখে আগুনের ছ্যাকা দিল রোদ।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। বিকেলেই এত কড়া! দুপুরে কি অবস্থা?
বুঝবে কালই, বলল জিনা। বিমান বন্দর থেকে বন্ধুদের এগিয়ে নিতে এসেছে। তবে ভাল জিনিসও অনেক আছে। একটু পরেই দেখতে পাবে লেবু বাগান। যা মিষ্টি গন্ধ!
একটা স্টেশন ওয়াগনের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণ, ওদের দেখে সোজা হলো। মাথায় লম্বা কালো চুলের বোঝা, নীল চোখ। বয়েস বিশের বেশি না।
টনি, পরিচয় করিয়ে দিল জিনা। চাচার র্যাঞ্চে কাজ করে।…টনি, ওরা তিন গোয়েন্দা। ওদের কথাই বলেছিলাম।
হাউ ডু ইউ ডু-র পালা শেষ হলো। গাড়িতে চড়ল সবাই। টনি। বসল চালকের আসনে।
জিনা, কিশোর বলল, তোমার চেহারাই বলছে, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে? ঘটনাটা কি?
চাচা, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল জিনা, হাসপাতালে। গতরাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ক্যাচিনার অভিশাপ, গাড়ি চালাতে চালাতে বলল টনি। আগে কিছুটা সন্দেহ ছিল, কিন্তু এ-ঘটনার পর আর অবিশ্বাস করতে পারছি না।
কিসের অবিশ্বাস? কিশোরের প্রশ্ন।
ভূত নাকি? জিজ্ঞেস করল মুসা।
আরে না, ভূতফুত কিছু না, মাথা নাড়ল জিনা। পাহাড়ের ওপর আগুন দেখেছে।
ভ্রুকুটি করল কিশোর। খুলে বলল।
গতরাতে আমরা ঘুমিয়ে পড়ার পর ঘটেছে ঘটনাটা, ঝাড়া দিয়ে মুখের ওপর থেকে তামাটে চুলের গোছা সরাল জিনা। মরুভূমির রোদে পুড়ে গাঢ় হয়ে গেছে চামড়ার রঙ। চাচার নাকি ঘুম আসছিল না। ছাতে গিয়েছিল হাঁটাহাঁটি করতে। হঠাৎ পাহাড়ে উজ্জ্বল আলো দেখতে পেল।
আলো না বলে বরং বলল আগুন, শুধরে দিল টনি। আগুন। জ্বেলে সঙ্কেত দিয়েছে, কোন সন্দেহ নেই।
জোরে নিঃশ্বাস ফেলল জিনা। গতরাতে পূর্ণিমা ছিল, তাই ঘরের আলো সব নিভিয়ে দিয়েছিল চাচা। আলো দেখে ছাত থেকে নেমে বাইরে বেরোচ্ছিল। হলঘর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেল ক্যাচিনাটাকে…
শুধু ক্যাচিনা নয়, ক্যাচিনা ভূতটাকে, আবার শুধরে দিল টনি। বিমান বন্দর ছাড়িয়ে শহরে ঢুকেছে গাড়ি, রাস্তার দিকে মনোযোগ দিতে হচ্ছে তাকে।
কি দেখেছে কে জানে, নাকমুখ বিকৃত করে বলল জিনা। আলো ছিল না। অন্ধকারে সিঁড়িতে কিসে যেন পা বেধে গিয়ে-কার্পেটেই হবে হয়তো, আছাড় খেয়ে পড়েছে। হলরুমে সিঁড়ির গোড়ায় পেয়েছি তাকে।
মাথা ঝাঁকাল টনি। হ্যাঁ। সিঁড়ি থেকে পড়েছে। কব্জি ভেঙেছে, গোড়ালি মচকেছে। ডাক্তার বলল, ভাল হতে হপ্তাখানেক লাগবে।
সমবেদনা জানাল মুসা আর রবিন, কিন্তু কিশোর চুপ। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কয়েকবার। আচ্ছা, ওই ক্যাচিনা ভূতটাকে কি আগেও দেখা গেছে?
কেউ কেউ নাকি দেখেছে, জিনা জবাব দিল। আমি দেখিনি।
উইলসন আংকেল বিশ্বাস করেন?
না।
ওই ভূতের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি তথ্য কে দিতে পারবে?
এক মুহূর্ত চুপ রইল জিনা। বোধহয় জুলিয়ান। দিনরাত টই টই করে ঘুরে বেড়ায় পাহাড়ে, মরুভূমিতে।
জুলিয়ান?
ভিকিখালার ভাইপো। নিজের কাছে নিয়ে এসেছে খালা। তার স্বামী, মানে আঙ্কেলও চলে এসেছে তার কাছে। আঙ্কেল স্কুল-মাস্টার। জুলিয়ানকে পড়ানোর ভার নিয়েছে। আশা করছে, বসন্তের শেষে স্কুল খুললেই ভর্তি করে দেবে।
কদ্দিন হলো এসেছে?
এই মাস দুয়েক। ভিকিখালার ভাই ভিয়েতনামে চলে গিয়েছিল, বিয়ে করেছিল ওখানেই। জুলিয়ানের মা ভিয়েতনামী মহিলা। ভালই ছিল তারা, কিন্তু হঠাৎ কার অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল জুলিয়ানের বাবা।
আহ্হা! আফসোস করল মুসা। চুকচুক করল জিভ দিয়ে।
তারপর? জিজ্ঞেস করল রবিন।
বিদেশীকে বিয়ে করায় জুলিয়ানের মায়ের ওপর তার আত্মীয় স্বজনরা চটা ছিল। জুলিয়ানের বাবা মারা গেলে আবার বিয়ে করতে বাধ্য করল মহিলাকে। সত্বাপ ভাল চোখে দেখল না ছেলেটাকে। শেষে ভিকিখালার কাছে চিঠি লিখল মহিলা। ওই এক ফুফু ছাড়া বাপের কুলের আর কোন আত্মীয় নেই জুলিয়ানের।
বয়েস কত ওর? জানতে চাইল কিশোর।
বারো, জবাব দিল টনি। কণ্ঠে বিরক্তির ছোঁয়া।
জিনাও বিরক্ত হলো। তুমি ওকে দেখতে পারো না তাই এমন করো। ও তোমার কি ক্ষতি করেছে?
ক্ষতি কি আর আমার করে? করছে তো তোমাদের। মিস্টার উইলসনের দুর্ঘটনার জন্যে ও-ই দায়ী, কাচিনা নয়।
মানে? রহস্যময় চিঠিটার কথা ভাবল কিশোর।