পেছনের দরজা দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল তিনজনে।
ভিকি রান্না করছে, একা, আর কেউ নেই ঘরে।
ফ্রিজ খুলে তিনটে লেমোনেড বের করে আনল মুসা। দুটো বোতল দু-জনের দিকে ঠেলে দিল। চেয়ার টেনে বসল তিনজনেই।
একবার মুখ ফিরিয়ে চেয়েই আবার রান্নায় মন দিল ভিকি। খুব ব্যস্ত।
এক চুমুকে অর্ধেকটা লেমোনেড শেষ করে ঠক করে বোতলটা টেবিলে নামিয়ে রাখল কিশোর।
মুসা, বড় বাঁচান বাঁচিয়েছ। আরেকটু হলেই গেছিলাম।
হাসল শুধু মুসা, কিছু বলল না।
কার শত্রু তুমি? কিশোরের দিকে চেয়ে ভুরু নাচাল রবিন।
সেটা জানতে পারলে তো রহস্যেরই সমাধান হয়ে যেত।
তন্দুর থেকে বিস্কুট বের করল ভিকি। হাত মুছে এগিয়ে এল টেবিলের কাছে। কি আলাপ করছ… টেবিলে রাখা তীরটা দেখে কুঁচকে গেল ভুরু। ওটা কোথায় পেলে?
কিশোরের মনে হলো, তীরটা ভিকির চেনা। পাল্টা প্রশ্ন করল, চেনেন নাকি?
হ্যাঁ, জবাব দিল ভিকি, জুলিয়ানের। ডাক্তারের র্যাঞ্চের কাউবয় বুড়ো জোহান বানিয়ে দিয়েছে। হাতে বানানো দেখছ না? পেছনের পালক লাগানো দেখেই বোঝা যায় অনেক কিছু। ইনডিয়ানদের কাছে। বানাতে শিখেছে জোহান।
হাতে বানানো যে সেটা তখনই বুঝেছি, কিশোর বলল।
পেলে কোথায়? আবার জিজ্ঞেস করল ভিকি। আবার কি ক্যাকটাস গাছে শুটিং প্র্যাকটিস করছিল নাকি?
কিশোরকে সই করে মেরেছে, রবিন বলল। ক্যাকটাস ঝাড়ের ভেতর থেকে। লোকটাকে দেখিনি। মুসা ধাক্কা দিয়ে না ফেললে তো গায়েই বিধত।
কিশোর! রক্ত সরে গেছে ভিকির মুখ থেকে। তু-তুমি নিশ্চয়। ভাবছ না… ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে। তীরটার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল, যেন ওটা বিষাক্ত সাপ।
না, জুলিয়ান নয়, আমি শিওর। কিন্তু ওর তীর অন্যের হাতে গেল কিভাবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভিকি। প্র্যাকটিস করতে গিয়ে কয়েকটা হারিয়েছে ঝোপে, আর ক্যাকটাসের ঝাড়ে। ডজনখানেক বানিয়ে দিয়েছিল জোহান। চারটা হারিয়েছে, আটটা থাকার কথা। কটা আছে গিয়ে দেখব?
দরকার নেই। জুলিয়ান তীর মারেনি আমাকে। মুসা আর রবিনের দিকে পর পর তাকাল কিশোর, আবার ভিকির দিকে ফিরল। আমার মনে হয়, এ কথাটা এখন কাউকে না জানানোই ভাল। চেপে যাব। জিনাকেও বলার দরকার নেই। শুনলেই রেগে হাউকাউ করে সবাইকে শোনাবে।
কিন্তু তোমার খুব বিপদ হতে পারে, কিশোর, প্রতিবাদ করল ভিকি।
তা হোক। তবু এ-রহস্যের সমাধান না করে আমি ছাড়ব না। টনি যেন এ কথা না শোনে। মিস্টার উইলসনকেও শোনানোর দরকার নেই। বাড়িতে আগুন লাগার কথা শুনেই নিশ্চয় মন খারাপ করে আছেন। দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়ে লাভ নেই। শেষে সবাই মিলে আমাকে তদন্তই করতে দেবে না।
তা ঠিক, শুনলে খুব চিন্তা করবেন, মাথা দোলাল ভিকি। হাসপাতাল থেকে চলে আসতে চাইবেন। উচিত হবে না। পুরোপুরি সুস্থ হননি এখনও। কিন্তু, কিশোর, তোমারও অহেতুক ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না। জুলিয়ানকে বরং তার মায়ের কাছেই পাঠিয়ে দেব। ধরে নেব, কপাল খারাপ ছেলেটার, থাকতে পারল না এখানে। কিংবা হয়তো আমিই এখানকার কাজ ছেড়ে দিয়ে ওকে নিয়ে শহরে চলে যাব। বাপমরা এতিম ছেলে, ফেলব কোথায়?
মায়ের কাছেও পাঠাতে হবে না, আপনাকেও কোথাও যেতে হবে না, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করল গোয়েন্দাপ্রধান। এ-রহস্যের কিনারা আমি করবই করব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
এক মুহূর্ত চুপ করে কিশোরের মুখের দিকে চেয়ে রইল ভিকি। বুঝল, কিছুতেই এখন আর ওকে ঠেকানো যাবে না। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে, যা ভাল বোঝো করো। কিন্তু খুব সাবধানে থাকবে। তোমার কিছু হলে, কোনদিন আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।
পরের দুটো দিন কিছুই ঘটল না।
অলসভাবে কাটল সময়।
অ্যাপাচি জাংশন দেখতে গেল তিন গোয়েন্দা। সঙ্গে গেল জিনা। নানারকমের দোকান আছে, ছোট ছোট জুয়েলারের দোকানই বেশি। নানারকম ইনডিয়ান অলঙ্কার রয়েছে প্রতিটি দোকানে। জিনার পছন্দে একটা করে চমৎকার বেল্ট কিনল ছেলেরা, রূপার বাকলসে একটা করে নীলকান্তমণি বসানো। যার যার বাড়ির লোকের জন্যে কিছু উপহার কিনল।
এক দোকানে একটা ক্যাচিনা পুতুল দেখে খুব পছন্দ হলো কিশোরের। বাহ, দারুণ তো! চাচীরও পছন্দ হবে। স্যুভনির হিসেবে খুব ভাল, না?
পুতুলটা বেশ চড়া দামে কিনে নিল সে। ওই দোকান থেকেই রাশেদচাচার জন্যে কিনল একটা সুন্দর ইনডিয়ান পাইপ।
জুলিয়ান, ভিকিখালা আর টনির জন্যেও একটা করে উপহার কিনল ওরা।
জিনা নিজের জন্যেও কিনল একটা রূপার চেন, লকেটের জায়গায় ছোট্ট একটা পাখি ঝুলছে। একটা কনডর। চোখ দুটো লাল পাথরের, ঝকঝক করে জ্বলছে।
চেনটা গলায় পরে বন্ধুদের দিকে ফিরল জিনা। কেমন লাগছে?
রাক্ষুসী, জবাব দিল মুসা।
কী? রেগে উঠল জিনা।
না না, ভুল করেছি, তাড়াতাড়ি হাত নাড়ল মুসা। মুচকি হেসে বলল, ওঝানী। ইনডিয়ান ওঝানী। চুলগুলোকে আরেকটু এলোমলো করো, মুখে রঙ লাগাও..
দেখো, ভাল হবে না বলছি। ভীষণ রেগে গেল জিনা। তুমি নিজে কি? তুমি তো একটা ভূত…
ঠিক বলেছ, দু-আঙুলে চুটকি বাজাল মুসা। বিকশিত হলো হাসি।
একটানে গলা থেকে চেনটা খুলে ফেলল জিনা। থাক! নেবই না!
না না, নাও, প্লীজ, হাতজোড় করে অনুরোধ করল মুসা। এমনি ঠাট্টা করছিলাম। এখানে এসে তোমার রাগ দেখিনি তো, কেমন যেন অন্য মানুষ অন্য মানুষ লাগছিল। তাই রাগিয়ে দিয়ে আসল রূপ…