লাগে, ফিরে এল লাজুক হাসি। জোহান আঙ্কেল শিখিয়েছে, কিন্তু ভাল পারি না এখনও। সে পারে, সামান্য চিহ্নও তার চোখ এড়ায় না।
জোহান আঙ্কেল কে?
ওই ওদিকে থাকে। ডাক্তারের র্যাঞ্চের কাউবয়। তীর-ধনুকও খুব ভাল বানাতে পারে। আমাকে অনেকগুলো বানিয়ে দিয়েছে।
সুপারস্টিশনের অনেক গলিঘুপচির খোঁজ নিশ্চয় পেয়েছ তুমি, জোহান আঙ্কেলের দৌলতে?
হুঁ, মাথা কাত করল জুলিয়ান। সময় পেলেই আমাকে নিয়ে যায়।
আস্তাবল থেকে বেরোল দু-জনে।
কি কি দেখো?
অনেক কিছু। ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যায় লোকে, পায়ে হেঁটে যায়। কেউ সোনা খুঁজতে, পুরানো খনিগুলো খোড়ে। পর্বতের গহীনে বনের কিনারে বাচ্চা নিয়ে বেরোয় কয়োটিরা। বাচ্চাকে শিকার শেখায়…
বাড়ির দিক থেকে ভিকির ডাক শুনে থেমে গেল জুলিয়ান। ফুপু ডাকছে, বলে দৌড় দিল সে।
তার পেছনে এগোল কিশোর। সে এখন নিশ্চিত, আগুন জুলিয়ান লাগায়নি। তবে সবার কাছে সেটা প্রমাণ করতে হবে। লোকে সন্দেহ করে, আড়চোখে তাকায়, নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগে ছেলেটার। লাগারই কথা।
সামনে এসে দাঁড়াল টনি। গম্ভীর। কি বলল?
টনির কণ্ঠস্বরে অবাক হলো কিশোর। কিসের কথা?
সারাদিন কোথায় কাটিয়েছে?
পর্বতে। কেন?
ডাক্তারের ওখান থেকে লোক এল এইমাত্র। ওদের দুটো ছাউনিতে আগুন লেগেছে। দুপুরের দিকে। ধোয়া দেখে আগুন নিভাতে গিয়ে দেখে বাঁচানোর আর কিছু নেই। পুড়ে ছাই। ওই জোহানটা হয়েছে যত নষ্টের মূল, ছেলেটাকে সে-ই প্রশ্রয় দেয়। নিজে এক শয়তান, ছেলেটাকেও শয়তান বানাচ্ছে।
কার কথা বলছ?
জুলিয়ান, আর কার।
ছাউনিতেও সে-ই আগুন লাগিয়েছে ভাবছ নাকি?
কিশোরের কথায় এমন কিছু রয়েছে, স্বর নরম করতে বাধ্য হলো টনি। ভাবতে তো খারাপই লাগছে। কিন্তু অন্য কেউ কেন ফাঁকা পড়ে থাকা ছাউনি পোড়াতে যাবে?
জুলিয়ানই বা কেন পোড়াবে?
থমকে গেল টনি। ভাবল। হয়তো ডাক্তারের ওপর রাগ। অ্যাপলুসা চুরির খবর ডাক্তার এসে দিয়েছে তো, সেজন্যে। কিংবা হয়তো ইনডিয়ান ইনডিয়ান খেলছে। খুব নির্জন এলাকা। ভেবেছে, কেউ দেখতে পাবে না।
দেখো, এ সবই অনুমান। প্রমাণ ছাড়া কাউকেই দোষী বলতে পারো না।
কিন্তু ডাক্তার জিংম্যান রেগে গেছে। মিস্টার উইলসনের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাছাড়া এখানে যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে। গোয়াল আর কোরালের দরজা খুলে গরু-ঘোড়া ছেড়ে দেয়া হয়েছে এতদিন, তেমন গায়ে মাখেনি ডাক্তার, কিন্তু আগুন লাগানো সহ্য করবে না। কেউই করবে না। আর বোধহয় জুলিয়ানকে রাখা যাবে না এখানে।
কিশোরের বলে ফেলতে ইচ্ছে হলো, তুমি রাখা না রাখার কে? বলল না। ভদ্রতা বজায় রেখে জিজ্ঞেস করল, ও কোথায় যাবে?
মায়ের কাছে।
খুব রাগ হলো কিশোরের। বাচ্চা একটা ছেলের বিরুদ্ধে বড়রা এভাবে উঠে-পড়ে কেন লেগেছে? চ্যালেঞ্জ করে বসল, জুলিয়ান করছে না এসব, এবং সেটা আমি প্রমাণ করে ছাড়ব। বলে আর দাঁড়াল না।
রিসোর্টের ভেতরে, আর পাতাবাহারের বেড়ার বাইরে বাকি দিনটা সূত্র খুঁজে বেড়াল তিন গোয়েন্দা। কিছু পেল না।
পাব কি? মুসা বলল। যা ছিল আগুনে পুড়েছে। বাকি যদি বা কিছু ছিল, নষ্ট করেছে ওই দমকল। কাদা বানিয়ে দিয়েছে।
বাকিটা নষ্ট করেছি আমরা, আনমনে বলল কিশোর। গতকাল দল বেঁধে গিয়েছি, ঘোড়ার খুরের ছাপ তো আর একটা-দুটো নয়। তার ওপর রয়েছে জীপের চাকা। আজ যদি কেউ গিয়েও থাকে ওপথে, ছাপ আলাদা করে চেনার উপায় নেই।
বাড়ির কাছে চলে এল আবার ওরা।
সূর্য অস্ত যাচ্ছে। কয়েক গুণ বড় হয়ে ছায়া পড়েছে বাড়িটার। সেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে বিচিত্র একটা অনুভূতি হলো কিশোরের, মনে হলো, আড়াল থেকে তার ওপর চোখ রাখা হচ্ছে। বাতাস গরম, তবু গায়ে কাঁটা দিল।
এতই তন্ময় হয়ে ভাবছে কিশোর, ক্যাকটাস ঝাড়ের ভেতর থেকে একটা রোডরানার বেরোনোর শব্দেও চমকে উঠল। একদিকে ছুটে পালাল পাখিটা। কাছেই লম্বা ঘাসের ভেতর ডেকে উঠল কোয়েল। কাছেই আরেকটা পাখি চেঁচিয়ে তার জবাব দিল।
কি ব্যাপার? উত্তেজিত মনে হচ্ছে পাখিগুলোকে।
ক্যাকটাসের ভেতরে নড়ে উঠল একটা ছায়া, পলকের জন্যে।
মুসার শিকারী চোখ এড়াল না সেটা। দুই ধাক্কায় দুই পাশে দাঁড়ানো কিশোর আর রবিনকে ফেলে দিয়ে নিজেও পড়ল ডাইভ দিয়ে।
ধনুকের টংকার শোনা গেল। শিস কেটে ছুটে এল কি যেন। খট করে আওয়াজ হলো। মুখ ঘুরিয়ে দেখল কিশোর, মুহূর্ত আগে সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, ঠিক তার পেছনের গাছটায় বিঁধেছে তীরটা। থিরথির করে কাঁপছে তীরের পালক লাগানো পুচ্ছ।
এগারো
খবরদার, মাথা তুলবে না! ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর। আস্তে আস্তে সরে যাও কোনার দিকে। ক্রল করে।
হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে ওরা, ভয় করছে, এই বুঝি আরেকটা তীর এসে গাঁথল পিঠে।
আর কিছু ঘটল না। নিরাপদে সরে এল বাড়ির কোণে।
সাবধানে, মাথা তুলল কিশোর। স্থির চেয়ে রইল ক্যাকটাসের ঝাড়টার দিকে। কোনরকম নড়াচড়া নেই। ছোট একটা পাখি উড়ে এসে বসল একটা ডালের মায়ায়। ফুলের মধ্যে ডুবিয়ে দিল চোখা, লম্বা ঠোঁট। মধু খেতে শুরু করল।
না, নেই কেউ ওখানে, পাখিটাকে দেখতে দেখতে বলল মুসা। চলে গেছে।
পায়ে পায়ে আবার গাছটার কাছে ফিরে এল ওরা। ডাল থেকে তীরটা খুলে নিল কিশোর।