করেছি, জিনা বলল। আস্তাবলের দিক থেকে ছুটে এসেছে। তার। পেছনে ভিকি। দু-জনের হাতে ঘোড়ার দানা রাখার চটের বস্তা। আসছে। ততক্ষণে আমরা যা পারি করি।
হাত লাগাল তিন গোয়েন্দা। বস্তাগুলো নিয়ে গিয়ে সুইমিং পুলের পানিতে চুবিয়ে আনল। আগুনের শিখার ওপর ছুঁড়ে ফেলতে লাগল এক এক করে। আরও বস্তা আনতে ছুটল জিনা আর ভিকি।
মোটেও দমছে না আগুন। দ্রুত বাড়ছে, চোখের পলকে ছড়িয়ে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়।
বাংলোটা বাঁচানো সম্ভব নয় বুঝে আশপাশের বাড়িগুলোর দেয়াল, ছাত ভিজাতে শুরু করল টনি আর ডিউক। যাতে ওগুলোতেও আগুন ছড়াতে না পারে।
আগুন কি আর এত সহজে ঠেকানো যায়। বাংলোর পাশের শুকনো ঘাসে ধরল, লেগে গেল পাতাবাহারের বেড়ায়, ধরতে শুরু করল তার ওপাশের ঝোঁপঝাড়ে, বুনো ফুলের ডালপাতা আর ক্যাকটাসে। দ্রুত থামাতে না পারলে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়বে মরুভূমিতে।
ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন যেন। একটা শিখা কোনমতে নিভালে আরেক জায়গায় তিনটা জ্বলে ওঠে। পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে ঘন কালো ধোয়া-আস্তাবলের কাছে উড়ে গেল, ভেতরে ঢুকে বিষাক্ত করে তুলল বাতাস, শ্বাস নিতে না পেরে অস্থির হয়ে পা ঠুকে চেঁচামেচি জুড়ল ঘোড়াগুলো। দৌড় দিল জিনা। আস্তাবলের ঝাঁপ খুলে দিতে হবে, তাহলে কোরালে বেরিয়ে যেতে পারবে জানোয়ারগুলো।
ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে হাজির হলো দমকল বাহিনীর ঘোট একটা
গাড়ি, ফায়ার ইঞ্জিন।
কালিঝুলিতে একাকার হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা, দরদর করে ঘামছে। সরে এল দূরে। তাদের সাধ্যমত করেছে। এবার দমকল বাহিনীর দায়িত্ব।
ফায়ার ইঞ্জিনের সঙ্গে লড়াই করে টিকতে পারল না আগুন, নত হয়ে এল উদ্ধত শির, গর্জন কমছে।
উত্তেজনা প্রশমিত হতেই ক্লান্তি টের পেল তিন গোয়েন্দা। ধপ করে বসে পড়ল পুলের কাছে সাজিয়ে রাখা চেয়ারে।
ধরল কিভাবে, টনি? একজন ফায়ারম্যান জিজ্ঞেস করল। হেলমেট আর ইউনিফর্ম পরে থাকায় লোকটাকে এতক্ষণ চিনতে পারেনি ছেলেরা, বিল হিগিনস-তাদের সঙ্গে পিকনিকে গিয়েছিল যে।
মাথা নাড়ল টনি। জানি না। ঘুমিয়ে ছিলাম। জিনার চিৎকারে জেগেছি।
একসঙ্গে জিনার দিকে ঘুরে গেল কয়েক জোড়া চোখ।
কেউ প্রশ্ন করার আগেই জিনা বলল, নাকে ধোঁয়া ঢুকেছিল, কিংবা পোড়া গন্ধে ঘুম ছুটে গেছিল। চোখ মেলতেই জানালায় আলো দেখলাম। উঠে দেখি, আগুন। ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, সারা রিসোর্টেই আগুন লেগেছে।
ও এদিক-ওদিক তাকাল বিল। পুবের আকাশ মুক্তোর মত সাদা, মরুর ভোর আসছে। পোড়া জায়গা, লন আর ঝোঁপঝাড় এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেদিকে চেয়ে বলল, ভাগ্য ভাল, সময়মত টের পেয়েছ। শুকিয়ে ঝনঝনে হয়ে আছে সব কিছু, আর খানিকটা সময় পেলেই জ্বালিয়ে ছারখার করে দিত।
কফি আর স্যাণ্ডউইচে চলবে তোমাদের? দরজার কাছ থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল ভিকি। তার পেছন থেকে বেরোল জুলিয়ান, দু হাতে দুই ট্রে।
আরে, খালা, কখন করেছ এসব? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল জিনা।
দমকল আসতেই বুঝলাম; জবাব দিল ভিকি, আমার আর দরকার নেই এখানে। জুলিয়ানকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম।
খুব আগ্রহের সঙ্গে প্লেট নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল সকলেই।
দারুণ হয়েছে তো স্যাণ্ডউইচ, মুখভর্তি খাবার, দুই গাল ফুলে উঠেছে মুসার। কে বানিয়েছে?,
জুলিয়ান, জানাল ভিকি।
স্যাণ্ডউইচের তারিফ করল সবাই। লাজুক হাসি ফুটল জুলিয়ানের মুখে।
ভাজা মাংসের ওপর পনিরের হালকা আস্তরের পুর দেয়া স্যাণ্ডউইচগুলো এই মুহূর্তে বেশি সুস্বাদু লাগার আরেকটা কারণ, প্রচণ্ড উত্তেজনা আর পরিশ্রমে সবাই ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। লড়াই জেতার আনন্দ সবার মনে।
তবে জুলিয়ানের হাসি মুছে গেল খুব তাড়াতাড়ি, যখন একজন ফায়ারম্যান পোড়া বাংলোটা দেখিয়ে বলল, ওখানে আগুন ধরাটা দুর্ঘটনা নয়, টনি। বাংলোতে লোক থাকে না যে সিগারেটের আগুন থেকে ধরবে। নাকি গতরাতে তুমি ছিলে ও-ঘরে?
জোরে মাথা নাড়ল টনি। না না। ওটার কাজ তো কবেই শেষ, উইলসন আঙ্কেলের অ্যাক্সিডেন্টের আগেই। তারপর আর ওটার কাছে যাওয়ারও সময় পাইনি। অয়্যারিং বাকি ছিল, আঙ্কেল এলে করা হত, জানোই তো।
ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কিশোর। জিজ্ঞেস করল, আগুনটা লাগানো হয়েছে ভাবছেন?
কেউ কিছু বলার আগেই চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করল জুলিয়ান, আবার যেন আমার দোষ দিয়ে বসবেন না! আমি লাগাইনি! উঠে দাঁড়িয়েছে। সে, হঠাৎ ঝাঁকুনিতে হাতের গেলাস থেকে ছলকে পড়ে গেল দুধ। আমি আগুন লাগাইনি!
কেউ কিছু বলল না।
গলা পরিষ্কার করে নিল ভিকি। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই গেলাস রেখে দৌড় দিল জুলিয়ান। কোরাল থেকে বের করে আনল তার, সাদা-কালো পিন্টো ঘোড়াটা। জিন-লাগাম ছাড়াই তাতে চড়ে বসল, ইনডিয়ানদের মত। খালি-পিঠে বসে গলা জড়িয়ে ধরে সোজা ছুটল মরুভূমির দিকে।
ওকে কিছু বলিনি আমি, ভিকির দিকে চেয়ে অপরাধী-কণ্ঠে বলল কিশোর। যাব ওর পিছে? ফিরিয়ে আনব?,
লাভ নেই, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ভিকি। ধরতে পারবে না।
ওকে দোষ দিয়েছ কেন ভাবল? কিশোরের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই যেন প্রশ্নটা করল রবিন।
সবাই দেয় তো, তাই, অস্বস্তি ফুটেছে ডিউকের চোখে। সিগন্যাল দেয়ার জন্যে সেই যে পাহাড়ে একবার আগুন জ্বালল, তাতেই হলো কাল। সবাই এখন খালি তার দোষ দেয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না এসব জুলিয়ানের কাজ… ধরে এল গলা। মাথা ঝাঁকিয়ে যেন আবেগ তাড়ালেন। স্যাগুয়ারো ক্যাকটাস আর বেড়ায় আগুন দেয়া। এক কথা, আর বাংলোতে আগুন লাগানো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।