পাহাড়ে উঠে পড়েছে ঘোড়া, ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল আরেক পাশে। নামছে না বলে পড়ছে বলাই ঠিক। আলগা পাথরের ছড়াছড়ি, পা আটকাতে পারছে না, পিছলে যাচ্ছে দ্রুত। নিচে খাদ। অন্ধকার। কতখানি গভীর, বোঝা যায় না।
আতঙ্কিত হয়ে রাশ, ছেড়ে দিয়ে জিনের শিং আঁকড়ে ধরল কিশোর। ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়লে এখন হাড়গোড় আর আস্ত থাকবে না। ভয়ে তাকাতে পারল না নিচের দিকে।
কিছুতেই পা আটকাতে পারছে না ঘোড়াটা। পিছলে পড়ছে, সেই সঙ্গে ঝুরঝুর করে পড়ছে আলগা পাথর আর বালি। পেছনে চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কোন সাহায্যই করতে পারবে না ওরা। বাঁচামরা নির্ভর করছে এখন ঘোড়ার পায়ের ওপর, কোনমতে যদি পাথরে বা মাটিতে খুর আটকায়, তাহলেই শুধু বাঁচার আশা আছে।
আট
প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগল। হাত ছুটলে ঘোড়ার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে যেত কিশোর।
থেমে গেল ঘোড়া।
জিনের শিং চেপে ধরে রেখে আস্তে মাথা তুলল কিশোর। নাহ্, থেমেছে। খাদে নেমে পড়েছে ওরা। গভীরতা একেবারেই কম খাদটার, এ যাত্রা প্রাণে বাঁচল তাই।
রাশ ধরল আবার কিশোর। ঘোড়াটার মতই ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ছে। থরথর করে কাঁপছে সারা শরীর। কাঁপছে ঘোড়াটাও।
কিশোর, কিশোর? খাদের কিনার থেকে জিনার ডাক শোনা গেল। তুমি ভাল আছ?
আছি! কম্পিত কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। সামনের একটা পা ঝাড়ছে ওটা। চেঁচিয়ে বলল সে, ঘোড়াটাকে দেখা দরকার। পায়ে আঘাত লেগেছে মনে হয়।
খাদের ঢালু পাড় বেয়ে নেমে এল সবাই। টর্চ জ্বালল রবিন। আরও দুটো টর্চ জ্বলে উঠল। ঘোড়াটার দিকে ছুটে এল টনি। পা পরীক্ষা করতে বসল।
কি হয়েছিল? জিনা জিজ্ঞেস করল।
র্যাটলম্নেক, জানাল কিশোর। চমকে ভয় পেয়ে ঘোড়াটা দিল দৌড়। থামাতে পারলাম না। টনির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, কি মনে হয়? সাপে কেটেছে?
পায়ে হাত বোলাল টনি। দাগটাগ তো দেখছি না। হাঁটু গেড়ে পড়ে ছিল। আর এই যে, সামান্য চামড়া ছুলেছে। অন্য কোন জখম নেই।
কিন্তু ওটায় আর চড়া যাবে না, জিনা বলল। কারও সঙ্গে ডাবল রাইড করতে হবে।
অসুবিধে নেই, মুসা বলল। আমার সঙ্গেই যেতে পারবে ও।
বিল এগিয়ে এল। সাপটা ছিল কোথায়?
দেখিনি, মাথা নাড়ল কিশোর। খড়খড় শুনলাম।
মনে হলো উড়ে এসে পড়ল ঘোড়ার কাছে।
উড়ে! জিভ টাকরায় ঠেকিয়ে বিচিত্র শব্দ করল বিল, মাথা নাড়ল, নাহ, মানতে পারছি না। মানুষ আর ঘোড়া দেখলে সাপ বরং সরে যায়। একেবারে পায়ের তলায় না পড়লে কামড়ায় না। ওড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, কারণ ডানা নেই, লাফিয়ে এসে পড়তে পারে বড়জোর। ভুল দেখোনি তো? ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়েছে আসলে, তাই না?
না।
দেখি, কেউ একটা টর্চ দাও, হাত বাড়াল বিল। আর আমার ঘোড়াটা ধরো। কোথায় সাপ, দেখে আসি।
কোমরের বেল্টে ঝোলানো টর্চটা খুলে দিল মুসা।
সাবধান, বিল, মুখ ফিরিয়ে বলল টনি। দেখেশুনে যেয়ো। মারা পড়ো না।
জবাব দিল না বিল, হাঁটতে শুরু করেছে।
ঘোড়ার পা ভালমত দেখে উঠে দাঁড়াল টনি! না, তেমন খারাপ কিছু না। বেঁচে গেছে।
তবে ভয় পেয়েছে খুব, জিনা বলল, দেখছ না, এখনও কেমন করছে? চোখ থেকে ভয় যায়নি।
অপেক্ষা করছে সবাই। সাপের গল্প শুরু করল একজন, আরেকজন যোগ দিল তার সঙ্গে, দেখতে দেখতে জমে উঠল গল্প। র্যাটলস্নেকের সামনে পড়েনি, এমন একজনও নেই ওখানে। সবারই কোন না কোন অভিজ্ঞতা আছে। কোনটার চেয়ে কোনটা কম রোমাঞ্চকর নয়।
বিল ফিরে এল।
কি দেখলে? তিন-চারজনে একসঙ্গে প্রশ্ন করল।
এই যে তোমার র্যাটলস্নেক, কিশোরের সামনে হাতের মুঠো খুলল বিল। সামান্য নড়াচড়ায়ই খড়খড় করে উঠল জিনিসটা। জোরে নিঃশ্বাস ফেলে পিছিয়ে গেল জখমী ঘোড়াটা, মাথা ঝাড়া দিয়ে টনির হাত থেকে লাগাম ছুটিয়ে পালানোর চেষ্টা করল।
কি এটা? এগিয়ে এল মুসা। এক হাতে ধরে রেখেছে ঘোড়ার লাগাম।
রবিন আর বিল, দু-জনের হাতের টর্চের আলোই পড়ল জিনিসটার। ওপর।
র্যাটলস্নেকের লেজ, জবাব দিল বিল। বেশ বড় ছিল সাপটা। মারার পর কেটে নেয়া হয়েছে এটা। টুরিস্ট স্যুভনির। পথের ওপর পড়ে ছিল।
কিন্তু…? কথাটা শেষ না করেই ঝট করে কিশোরের দিকে ফিরল জিনা, বড় বড় হয়ে গেছে চোখ। ঘোড়ার ওপর উড়ে এসে পড়েছে?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর।
ছুঁড়ে দিয়েছে কেউ? আবছা অন্ধকার থেকে বলল টনি, চোখ দেখা গেল না তার।
কিশোর, জিনার কণ্ঠে অস্বস্তি, বুঝতে পেরেছ কি বিপদ থেকে বেঁচ্ছে? ভাগ্য ভাল, খাদটা গভীর নয়। আশপাশে গভীর খাদও আছে, ওগুলোতে পড়লে…
পড়িনি যখন, আর বলে কি লাভ? জিনাকে থামিয়ে দিল কিশোর। আমি পুরোপুরি ভাল আছি, ঘোড়াটার কেবল সামান্য ছুলেছে। এই তো, ব্যস। উপস্থিত সবাইকে সব কথা জানাতে চায় না সে, তাই আর ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করল না। কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন করল, তাকে সরিয়ে দেয়ার আরেকটা চেষ্টা চালানো হলো। কে সেই লোক, যে চায় না রহস্যের সমাধান হোক?
জিনা, মুসা আর রবিনের মনেও একই প্রশ্ন।
সওয়ারী নিতে পারবে জখমী ঘোড়াটা, গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে টনি চাপল ওটাতে। তার ঘোড়াটা দিল কিশোরকে। ধীরে ধীরে শুকনো নদীর ধার ধরে আবার চলল কাফেলা। তিন গোয়েন্দাকে সরিয়ে মাঝখানে রাখা হলো, যাতে আর কোনরকম বিপদ ঘটতে না পারে।