জন্তু-জানোয়ারের কথা উঠলে সবচেয়ে বেশি খুশি হচ্ছে জুলিয়ান। হরিণ আর শুয়োর গোষ্ঠীর প্রাণী হ্যাঁভেলিনার কথা বলতে গিয়ে চকচক করে উঠল বড় বড় চোখ। পর্বতের ভেতরে, ঝর্নার মাথায় খাড়ির ধারে, মরুভূমিতে নাকি প্রায়ই দেখে ওসব জানোয়ার।
বড় হয়ে ওসব শিকার করব আমি, বলল জুলিয়ান। উইলসন আঙ্কেল বলে, আমার বয়েসেই নাকি তীর দিয়ে হরিণ মেরেছিল সে। তীর-ধনুক আমারও আছে, কিন্তু নিশানা ঠিক না। একদিকে মারলে আরেকদিকে চলে যায়।
আঙ্কেল খুব আদর করেন তোমাকে, না?
হ্যাঁ, অনেক।
সেজন্যেই তো বলি, চুলার কাছ থেকে বললেন শিক্ষক,
আঙ্কেলকে বেশি জ্বালিয়ো না। আরেকটা ব্যাপারে সাবধান করব, খবরদার, হ্যাঁভেলিনার ধারে-কাছেও যেয়ো না। লম্বা লম্বা দাঁত, যা ধার। পেট চিরে নাড়ি-ভুড়ি বের করে দেবে।
আরে, দূর, আঙ্কেল যে কি বলো। তুমি একটা আস্ত বোকা। আমি ঘোড়া থেকে নামব নাকি? পেটের নাগাল পাবে কোথায়?
জুলিয়ানের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে কিশোরের, বকবক করে চলল।
খাবার তৈরি, ডাকল ভিকি। এই, তোমরা সবাই এসো।
খাবারের স্বাদ এত ভাল খুব কমই লেগেছে তিন গোয়েন্দার কাছে। মোটাতাজা কচি একটা আস্ত ভেড়ার কাবাব, ঠ্যাং ওপরে, শিকে গাঁথা অবস্থায় ঝুলছে আগুনের ওপর। মাংস কেটে প্লেটে নিয়ে তার ওপর ঢেলে দেয়া হয়েছে টমেটোর সস। সেই সঙ্গে আছে শিম, দু-ভাবে রান্না হয়েছে। আগুনের ওপর তন্দুরী রুটির মত সেঁকা, আর মেকসিকান পদ্ধতিতে চর্বি দিয়ে ভাজা। তাতে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে পেঁয়াজ আর পনিরের কুচি। বাঁধাকপি আর আলুও আছে। মদের বালাই নেই, তার বদলে বরফ মেশানো পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানি। সব শেষে দেয়া হবে ঘরে বানানো অ্যাভোকাডোর জেলি, তাজা কমলা এবং আঙুর।
কেমন লাগছে? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল জিনা।
এর নাম যদি ডায়েট কন্ট্রোল হয়, সারা জীবন করতে রাজি আছি আমি, চিবাতে চিবাতে বলল মুসা।
ডায়েট কন্ট্রোল কে বলল তোমাকে? ওপাশ থেকে হাসল ভিকি। এ তো পিকনিক।
তাহলে সারাজীবন পিকনিকই করে যাব।
মুসার কথায় না হেসে পারল না কেউ।
প্রচুর হই-হুঁল্লোড় আর হাসি-ঠাট্টার মাঝে শেষ হলো খাওয়া।
ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল মুসা।
টনি আর তার বন্ধুরা গেল শুকনো কাঠ-কুটো জোগাড় করার জন্যে।
পাহাড়ী অঞ্চল, তাড়াতাড়ি ডুবে গেল সূর্য। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার এসে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। অগ্নিকুণ্ড তৈরিই আছে, তাতে শুকনো লাকড়ি ফেলতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। চারপাশে গোল হয়ে বসল সবাই।
জীপ থেকে গিটার বের করে আনল টনি, বাজাতে শুরু করল। স্বপ্নিল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে শীলা। ব্যাপারটা তিন গোয়েন্দার নজর এড়াল না। কিশোরের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে চোখ টিপল মুসা।
বাজনার তালে তালে মাথা দোলাচ্ছে সবাই। গান শুরু করল জিনা। তার সঙ্গে গলা মেলাল শীলা আর বিল। ডিউক আর ভিকিও বাদ রইল না। রবিন শুরু করতেই তার সঙ্গে যোগ দিল মুসা।
গানটান আসে না কিশোরের, গলা মোটেই ভাল না। শুয়ে পড়ল। সে, আকাশের দিকে চোখ। তারা ঝিলমিল করছে, নির্মেঘ রাতে অনেক বড় দেখাচ্ছে তারাগুলোকে। এত কাছে লাগছে, মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। এমন সুন্দর রাত খুব কমই আসে মানুষের জীবনে, ভাবল সে।
চাঁদ উঠলে রওনা হব আমরা, গানের ফাঁকে বলল টনি।
যে-পথে এসেছি সে-পথে? দু-হাত নাড়ল মুসা। তাহলে, বাবা, আমি নেই। অন্ধকারে খাদে পড়ে কোমর ভাঙতে পারব না।
না, অন্য পথে যাব, মুসার শঙ্কা দূর করল টনি। সহজ পথ।
গান-বাজনা চলছে। তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিচ্ছে ভিকি আর তার স্বামী। জীপে তুলছে।
চাঁদ উঁকি দিল পাহাড়ের মাথায়। উঠে বসল কিশোর। এতক্ষণে খেয়াল করল, জুলিয়ান নেই। তার ঘোড়াটাও নেই। কোন্ ফাঁকে চলে গেছে।
জীপে করে রওনা হয়ে গেল স্বামী-স্ত্রী।
ছেলেমেয়েরা ঘোড়ায় চেপে চলল। র্যাঞ্চে ফিরে চলেছে। দ্রুত ঠাণ্ডা হচ্ছে রাতের বাতাস।
জ্যাকেট এনে ভালই করেছি, জিনে বাঁধা জ্যাকেটটা খুলে নিতে নিতে বলল রবিন।
টনি তো বললই তখন, রাতে খুব ঠাণ্ডা পড়বে, কিশোর বলল।
পাশাপাশি চলেছে তিন গোয়েন্দা, তাদের পাশে জিনা। বলল, রাতে ভীষণ ঠাণ্ডা পড়ে মরুভূমিতে। এমন, কি গরমের দিনেও শীতকালের মত ঠাণ্ডা।দিনে আবার দোজখের আগুন জ্বলে।
আর বিশেষ কোন কথা হলো না। শুকনো একটা নদীর কূল ধরে রুক্ষ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে দলটা।
গভীর চিন্তায় নিমগ্ন কিশোর। ক্যাচিনা ভূতের কথা ভাবছে, জুলিয়ানের রহস্যময় আচরণের কথা ভাবছে, এরই ফাঁকে ফাঁকে মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে হারানো সোনার খনির কথা, দ্য লস্ট ডাচম্যান মাইন। ঘোড়াটা যে ধীরে চলছে, খেয়াল করছে না। পেছনে পড়ল ঘোড়া, পথ থেকে সরে এল। পাহাড়ের ঢালে জন্মে থাকা রসাল সবুজ ঘাসের দিকে নজর।
হঠাৎ শোনা গেল বিচিত্র খড়খড় শব্দ। চমকে উঠে ঘুরে গেল ঘোড়া, আরেকটু হলেই পিঠ থেকে কিশোরকে ফেলে দিয়েছিল। লাগামের দুই মাথার একটা ছুটে গেল তার হাত থেকে, আরেকটা আঁকড়ে ধরে, দুই হাঁটু ঘোড়ার পেটে চেপে কুঁজো হয়ে রইল সে।
আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেছে ঘোড়াটা, কোন্দিকে যাচ্ছে হুঁশ নেই। হাজার চেষ্টা করেও তাকে পথে আনতে পারল না কিশোর।