জিনার চোখে শঙ্কা। সেটা গোপন করার জন্যে অন্যদিকে চেয়ে বলল, যা হবার হয়েছে। করতে তো আর কিছু পারেনি তোমার। জোর করে হাসল। যাও, পুলে গিয়ে খানিকক্ষণ দাপাদাপি করে এসো। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও। রাতে জাগতে হবে।
মন্দ বলনি, সাঁতারের কথায় হাসি ফুটল মুসার মুখে।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে, কাপড় পরে ঘর থেকে বেরোল তিন গোয়েন্দা। মেহমানরা এসেছে, অপেক্ষা করছে। জিনার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় একটা মেয়ে, নাম শীলা। অন্য চারজন ছেলে, সতেরো থেকে বিশের মধ্যে বয়েস।
পরিচয়ের পালা শেষ হলো।
ঘোড়ায় জিন পরিয়ে তৈরি রেখেছে টনি। আস্তাবলে গিয়ে যার যার ঘোড়া বেছে নিল সবাই।
টাইগারেরও সঙ্গে যাওয়ার খুব ইচ্ছে, লেজ নাড়ছে, ঘেউ ঘেউ করছে। শেকলে বাঁধা, সামনে প্রচুর খাবার থাকা সত্ত্বেও ছুঁয়ে দেখছে না। তাকে নিতে রাজি নয় ভিকি, তাই এই ব্যবস্থা করে রেখে গেছে।
রওনা হলো দলটা।
মুসার পাশে চলছে টনি। কিশোর চলে এল বিল হিগিনসের পাশে। হাসিখুশি তরুণ, মাথায় কালো চুল। অপরিচিত মানুষকে সহজে আপন করে নিতে জানে। চলতে চলতে কিশোরকে আশপাশে অনেক কিছু দেখাল সে, মরুভূমি আর পর্বত সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য জানাল।
লস্ট ডাচম্যান মাইনে গিয়েছ কখনও? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
গেছি, হাসল বিল। সাত-আট বছর বয়েসে, বাবার সঙ্গে। সোনাও পেয়েছি। না না, চমকে ওঠার কিছু নেই। খুব সামান্যই পেয়েছি। মাত্র দু-চার আউন্স।
ডাচম্যান মাইনে!
না, মাইনে পেয়েছি বলা যাবে না। সোনার ছোটখাটো দু-চারটা পকেট আর শিরা ওখানে আছে এখনও। শীতকালে বৃষ্টি হলে বন্যার পানিতে ধুয়ে চলে যায় মাটি। বেরিয়ে পড়ে একআধটা পকেট কিংবা শিরা। মাঝেসাঝে কিছু সোনা পাওয়া যায় তখন, খুবই সামান্য। এমন কিছু না।
স্বর্ণের আলোচনা শুনে পেছন থেকে এগিয়ে এল রবিন। তার পাশাপাশি এল আরেকটা ছেলে, নাম পিটার। কিছুটা লাজুক স্বভাবের। হেসে বলল, থাকো কিছুদিন এখানে, একদিন নিয়ে যাব খনি দেখাতে। চাই কি, ভাগ্য ভাল হলে সোনার তাল কিংবা নুড়ি পেয়েও যেতে পারো।
জিনাও এগিয়ে এল। সোনার লোভ না দেখিয়ে কিশোরকে রহস্যের লোভ দেখাও, হাসল সে। বলো না, লস্ট ডাচম্যান মাইনটা খুঁজে বের করে দিতে।
সে কি! ওটা এখনও হারানোই আছে? বিলের দিকে তাকাল। কিশোর। এই না বললে, এখানকার সবাই গেছে?
তা তো গেছেই, শীলাও হাসল। খনিটাতে যাওয়ার অন্তত পঁচিশটা ম্যাপ দিতে পারি তোমাকে, পঁচিশ রকমের, এবং সবগুলোই আসল। যেটা ধরেই যাও, খনি পাবে। তবে কেউই সঠিক বলতে পারে
আসল ডাচম্যান মাইন কোটা। এমনও হতে পারে, ওই পঁচিশটার কোনটাই মূল খনিটা নয়।
শীলা ঠিকই বলেছে, বলল আরেক তরুণ, কেন ফ্লেরেট।
হুঁ, রহস্যেরও খনি দেখছি এই এলাকা নিচের ঠোঁটে একবার চিমটি কাটল কিশোর। হাসল, কোনটা ছেড়ে কোনটার সমাধান করি?
এমনিতেই খুব জটিল একটা রয়েছে হাতে..
ভূতের রহস্য? বিল জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ।
ও, তোমাদের বলা হয়নি, জিনা, বলল, কিশোর কাল রাতে ভূতটাকে দেখেছে।
রুক্ষ উঁচুনিচু পাহাড়ী পথে চলতে চলতে জমে উঠল ভূতের গল্প। রাস্তা ভাল না, কিন্তু ঘোড়াটার কারণে চলতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না কিশোরের। শান্ত একটা মাদী ঘোড়ায় চেপেছে সে। তবু, কয়েকটা পাহাড় ডিঙিয়ে আরেকটা পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে যখন একটা উপত্যকা দেখতে পেল-গাছপালায় ঘেরা, ফুলে ছাওয়া, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝর্না, হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল।
জায়গাটাকে উপত্যকা না বলে চওড়া একটা গিরিপথ বলাই ভাল। দুই পাশেই উঁচু পাহাড়। গিরিপথের এক মুখের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। র্যাঞ্চের জীপ। রান্না চড়ানো হয়ে গেছে। বাতাসে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে খাবারের সুবাস।
নিচে নেমে ঘোড়া থেকে নামল অশ্বারোহীরা, এগিয়ে গেল। আগুন জ্বেলে রান্না বসিয়েছে ভিকি, তাকে সাহায্য করছেন তার স্বামী স্কুলশিক্ষক ডিউক। বলিষ্ঠদেহী লোক, সুস্বাস্থ্যের কারণে একটু বেঁটে দেখায়, ইনডিয়ানদের মত কুচকুচে কালো চোখ।
আশপাশে কোথাও জুলিয়ানকে দেতে পেল না কিশোর। সে কোথায়, ভিকিখালাকে জিজ্ঞেস করতে যাবে, এই সময় গাছের ফাঁকে দেখল সাদা-কালোর ঝিলিক। বন থেকে বেরোল পিন্টো ঘোড়াটা, তাতে বসে আছে জুলিয়ান।
ছেলেটাকে দেখে অস্বস্তি দূর হলো স্বামী-স্ত্রী দু-জনেরই।
এক জায়গায় বাধা হয়েছে সবগুলো ঘোড়া, জুলিয়ানও পিন্টোটা নিয়ে গেল ওখানে। কিশোর এগোল সেদিকে।
জুলিয়ানের সঙ্গে সহজ হতে সময় লাগল কিশোরের। খুবই লাজুক স্বভাবের ছেলে। দশটা প্রশ্ন করলে একটার জবাব দেয়।
কিন্তু তার ঘোড়াটার কথা তুলতেই মুখর হয়ে উঠল সে।
ও আমার, গর্বের সঙ্গে বলল জুলিয়ান, এক্কেবারে আমার। আর কারও না। উইলসন আঙ্কেলের কাছে একটা ঘোড়া চেয়েছিলাম। দিয়ে দিল। খুব সুন্দর।
চড়তেও পারো ভাল, বলল কিশোর। কে শিখিয়েছে? উইলসন আঙ্কেল?
হাতেখড়ি দিয়েছে। বাকিটা শিখিয়েছে ডিউক আঙ্কেল আর টনিভাইয়া। ওরা বলে, আমি নাকি দেখতে একেবারে ইনডিয়ানদের মত।
নানা রকম প্রশ্ন করে জুলিয়ানকে কথা বলিয়ে নিল কিশোর। তথ্য জোগাড়ের চেষ্টা করছে। সহজ হয়ে এসেছে জুলিয়ান, প্রশ্ন করলেই এখন জবাব দেয়। মিথ্যে বলছে বলে মনে হলো না, আর যদি বলেই থাকে, তাহলে মানতে হবে মস্ত অভিনেতা সে।