গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আবার ছুটল রোড রানার।
পারে। তবে দৌড়াতেই পছন্দ করে। ছোটে কি জোরে দেখছ না?
মানুষের সাড়া পেয়ে সামনের একটা ঝোঁপ থেকে আতঙ্কিত চিৎকার করে উড়াল দিল এক জোড়া কোয়েল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার মাটিতে নামল। ঝোঁপের ভেতর থেকে বেরোল ডজনখানেক বাচ্চা, মুরগীর বাচ্চার মত দেখতে। হলদে আর বাদামী পালকের ছোট ছোট বল যেন। চিক, চিক করছে। ঘাসের বীজ খুঁটে খেতে শুরু করল। গলা তুলে সতর্ক চোখে এদিকে চেয়ে রইল মা-বাবা, বিপদ বুঝলে হুশিয়ার করবে ছানাদের।
ছুটে গিয়ে ধরার জন্যে পাগল হয়ে উঠল টাইগার। কষে এক থাপ্পড় লাগাল মুসা। চুপ! ছিলি তো চোরের শাগরেদ। ভাল হবি কোত্থেকে? আমার সঙ্গে থাকলে বাপু তেড়িবেড়ি চলবে না। কান টেনে ছিঁড়ে ফেলব।
শান্ত হলো টাইগার। পেছনের দুই পায়ের ফাঁকে ঢুকিয়ে ফেলল লেজ।
পাখিগুলো যাতে ভয় না পায়, সেজন্যে ওগুলোর অনেক দূর দিয়ে ঘুরে এগোল ওরা।
পাহাড়ের ওপরে উঠে আগুন জ্বালানোর চিহ্ন চোখে পড়ল। বেশ কিছু শুকনো ডালপালা পড়ে আছে, আধপোড়া। কয়েকটা পোড়া ম্যাচের কাঠি পাওয়া গেল আশপাশে। ডালপালাগুলোর বেশির ভাগই বালি চাপা দেয়া।
আগুন নেভানোর চেষ্টা হয়েছিল, পোড়া ডালগুলো দেখাল কিশোর।
জুলিয়ান বোধহয় বালি ঢাকা দিয়েই ভেবেছে আগুন নিভেছে। সে চলে যাওয়ার পর আবার জ্বলে উঠেছে।
নেভানোর চেষ্টা তো অন্তত করেছে, মুসা বলল, তারমানে আগুন ছড়াক, এটা ইচ্ছে ছিল না।
জ্বালিয়ে ফেলে রেখে গেলেও কিছু হত না, রবিন বলল। আশপাশে তো কিছু নেই। ধরবে কিসে? বালি তো আর জ্বলে না যে আগুন ছড়াবে।
চলো, অন্য জায়গায় যাই, হাত তুলে দক্ষিণে দেখাল কিশোর।
পাহাড়ের শিরদাঁড়া ধরে চলল ওরা। খানিক দূর এগিয়ে নিচে দেখিয়ে মুসা বলল, ওই যে। পোড়া ক্যাকটাস।
ঢাল বেয়ে নিচে নামল ওরা। ওধার থেকে উঠে গেছে পাশের পাহাড়ের আরেকটা ঢাল। খড়খড়ে রুক্ষ মাটি, পাথরের ছড়াছড়ি। এখানে-ওখানে জন্মে আছে প্রিকলি-পার ক্যাকটাস, খালি কাটা, হুকের মত কাপড়ে গেঁথে গিয়ে টেনে ধরতে চায়।
দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী পথকে তো গিরিপথ বলে, মুসা বলল, দুই ঢালের মাঝখানকে কি বলে? গিরিঢাল?
কি জানি, আনমনে মাথা চুলকাল কিশোর, মুসার কথা ঠিক কানে গেছে বলে মনে হলো না। পোড়া, মস্ত স্যাগুয়ারো ক্যাকটাস গাছটার দিকে এগোচ্ছে। তার মাথায় এখন ভাবনার তুফান।
বোধহয় শৈলশিরা, মুসার প্রশ্নের জবাবে বলল রবিন।
গাছের গোড়ায় এসে চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখল কিশোর। বিড়বিড় করল, এখানে আগুন ধরিয়ে লাভটা কি? পাহাড়ের জন্যে কারও চোখে পড়বে না। সিগন্যাল দিলেই বা কি আর না দিলেই কি?
সেজন্যেই হয়তো এখানে ধরিয়েছে, অনুমান করল রবিন। দেখা যায়, এমন জায়গায় লাগিয়ে তো হেনস্তা কম হয়নি, তাই এখানে এসেছে।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। রবিনের কথা সমর্থন করল কিনা বোঝা গেল না। গাছের গোড়ায় পোড়া ডালপাতা খুঁজছে। কুড়িয়ে এনে জড় করে আগুন ধরানোর কোন চিহ্ন নেই। পোড়া একটা কয়লাও কোথাও পড়ে নেই, একটা ম্যাচের কাঠিও না। কোনখানে মাটিও সামান্যতম পোড়া নেই, শুধু গাছের একেবারে গোড়ায় ছাড়া। সিগন্যাল দেয়ার জন্যে ডালপালা জ্বাললে, আর সেখান থেকে এসে গাছে আগুন ধরলে, তার চিহ্ন থাকবেই। কিন্তু নেই।
দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিশোর। কি বুঝছ?
কেউ জবাব দেয়ার আগেই বড় একটা পাথরের চাঙড়ের দিকে চেয়ে ঘড়ঘড় করে উঠল টাইগার। লম্বা লম্বা ঘাস আর শুকনো এক ধরনের ঝোঁপ জন্মে আছে পাথরটাকে ঘিরে।
কি দেখল? ভুরু কোঁচকাল রবিন।
খরগোশ-টরগোশ বোধহয়, ধমক লাগাল মুসা, এই, চুপ!
আমার ধারণা, কিশোরের প্রশ্নের জবাবে বলল রবিন, সরাসরি গাছে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
কেন? মুসার জিজ্ঞাসা। একটা ক্যাকটাস গাছে আগুন লাগিয়ে কি এমন লাভ হলো কার?
কাঁধ ঝাঁকাল শুধু কিশোর, জবাব দিল না। নীরব। জোরে জোরে চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে পোড়া স্যাগুয়ারোর কালো ধ্বংসাবশেষের দিকে।
ঘুরে দাঁড়াল হঠাৎ সে। চলো, আর কিছু দেখার নেই।
ভোঁতা, প্রচণ্ড শব্দ হলো, মাটির তলায় চাপা দেয়া বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটল যেন। ঘেউ করে লাফিয়ে এসে কিশোরের গায়ে পড়ল টাইগার।
চমকে ফিরে তাকাল কিশোর। এক লাফে সরে গেল।
দুলে উঠেছে পোড়া স্যাগুয়ারোর মস্ত কাঠামো। পড়তে শুরু করল।
সাত
ধুড়ম করে পড়ল গাছটা। মুহূর্ত আগে কিশোর যেখানে ছিল ঠিক সেখানে। গোড়ায় মস্ত এক খোড়ল।
আরি, কি হলো! কাঁপছে রবিনের কণ্ঠ। কিভাবে…
টাইগার ধাক্কা না দিলে গেছিলাম, কিশোরও কাঁপছে।
একেবারে ভূতের আড্ডা! ভয়ে ভয়ে তাকাল মুসা! চলো, ভাগি।
আর কিছু করার নেই এখানে। ফিরে চলল ওরা।
র্যাঞ্চে এসে টনি আর জিনাকে জানাল সব।
আমারই দোষ, উনি বলল। আগেই বলা উচিত ছিল। এ রকম ঘটতে পারে ভেবে সেদিন গিয়েছিলাম কেটে ফেলতে। উইলসন আঙ্কেলের খবর শুনে তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম, পুরোটা আর কাটা হয়নি। ভেঙে পড়বেই তো।
তোমার দোষ নেই, টনিকে আশ্বস্ত করল কিশোর। সেজন্যে পড়েনি ওটা।
তাহলে…? থমকে গেল মুসা।
গাছ পড়ার আগে ধুপ করে যে শব্দটা হয়েছিল, নিশ্চয় শুনেছ। বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল গাছের গোড়ায়। পাথরের চাঙড়ের কাছে ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে ছিল লোকটা। ওর গায়ের গন্ধ পেয়েই তখন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল টাইগার। সবার মুখের দিকেই তাকাল এক এক করে। বোমা ফাটানো হয়েছে ইলেকট্রনিক ব্যবস্থায়, রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে।