জোর করে রবিনের বোঝা ভাগ করে নিল মুসা আর কিশোর।
দাঁতে দাঁত চেপে চলেছে জিনা। ঘোড়ায় চড়া আর ব্যায়ামের অভ্যাস আছে। বলে হাঁটতে পারছে এখনও। মুসা কষ্ট সহ্য করতে পারে, কাজেই কিশোর কিংবা জিনার মত হাঁপিয়ে ওঠেনি সে।
বেচারা রবিনের অবস্থা করুণ। মুখ চোখ লাল হয়ে গেছে, পায়ের গোড়ালি ফুলে গেছে, পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছে তার। তবু টু শব্দ করছে না, এগিয়ে চলেছে। সবার সাথে, কিন্তু খুব মন্থর।
ইসসি, দেরি করিয়ে দেবে দেখছি, বলল চ্যাকা।
রবিনের দিকে ফিরে হাসল জিম। সান্ত্বনা দিয়ে বলল, যতক্ষণ পারো, হাঁটো। পারলে বয়ে নিয়ে যাব। ভয় নেই।
রোদ যতই চড়ছে, গরমও বাড়ছে সেই অনুপাতে। দুপুরের দিকে তো মনে হলো, সেদ্ধ হয়ে যাবে একেকজন। থামল। কাপড় খুলে ঝপাং করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুসা।
একে একে সবাই নামল।
অনেকক্ষণ ধরে গোসল করল ওরা। তারপর গাছের ছায়ায় খেতে বসল। ভ্যাপসা গরম না থাকলে, আর পর্যাপ্ত খাবার থাকলে পিকনিক ভালই জমত।
বিকেলের দিকে যেন সহ্যশক্তির পরীক্ষা শুরু হলো। বিরূপ প্রকৃতি যেন। দেখতে চায়, তার দাপট কতখানি সইতে পারে অভিযাত্রীরা। রাফিয়ানের পর্যন্ত জিভ বেরিয়ে গেল।
রবিনের অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ডাল কেটে, তাতে কম্বল বেঁধে। স্ট্রেচার বানিয়ে বয়ে নেয়া হচ্ছে তাকে। খুব লজ্জা পাচ্ছে রবিন, নিজেকে দোষারোপ করছে। আছাড় খেয়ে পা ভাঙার জন্যে নিজেকেই দায়ী করছে।
পায়ের মাংসপেশীতে খিচ ধরে গেছে জিনা আর কিশোরের। আধমন ভারি মনে হচ্ছে একেকটা পা।
সামান্যতম প্রাণের সাড়া নেই কোথাও। এ-এক অদ্ভুত জঙ্গল। ভয় ভয়। লাগে। নীরবতা যেন ভারি হয়ে ঠাই নিয়েছে এখানে। কথা বলতে অস্বস্তি লাগে।
হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাত। সাঝ প্রায় হলোই না, এই দেখা গেল শেষ। বিকেল, পরক্ষণেই ঝপাত করে রাত্রি।
থামো, বলল জিম। এখানেই রাত কাটাব।
দিনটা যেমন গরম গেছে, রাতটা তেমনি ঠাণ্ডা হবে, গত কদিনে বুঝে গেছে ওরা। শুকনো ডালপাতা জোগাড় করে আগুন জ্বালল জিম। কয়েকটা কাঁচা ডাল কেটে তাতেও আগুন ধরাল। জুলবে ধীরে, ধোয়া হবে বেশি। মশা তাড়ানোর ব্যবস্থা। কিন্তু এই ধোয়ায় কি আর মশা যায়? ভারি চাঁদরের মত ঝাঁক বেধে এসে অভিযাত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
আগুনের চারপাশ ঘিরে বসে রাতের খাওয়া সারল ওরা। সবাই বিষণ্ণ। মন। হালকা করার জন্যে রসিকতা করল কিশোর, আমি যখন দাদা হব, তিন কুড়ি নাতিপুতি হবে, তাদেরকে এই অভিযানের গপ্পো শোনাব। চোখ এত্তো বড় বড় করে শুনবে ওরা। বিশ্বাস করতে পারবে না। বাবা-মাকে গিয়ে সেকথা জিজ্ঞেস করবে, সত্যি কিনা। ওরা ধমক দিয়ে বলবে, বাজে বকিস না। বুড়োহাবড়াটার সঙ্গে থেকে থেকে ছেলেগুলোর মাথাও গেল। খালি মিছে কথা। হি-হি।
কেউ হাসল না।
মুসা বলল, ইস, কি আমার গল্পরে! তা-ও যদি ইনডিয়ানরা আক্রমণ করে ধরে। নিয়ে যেত, শেষে অনেক কষ্টে পালাতাম, নাহয় এককথা ছিল। প্লেন থেকে নেমে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, রাতে মশার কামড় খাওয়া, হলো নাকি কিছু
এটা? যা জঙ্গল, বাঘ তো দূরের কথা, একটা শেয়ালও নেই।
এত বড় বড় কথা বোলো না, অন্য ধার থেকে হুঁশিয়ার করল চ্যাকো। ইনডিয়ান নেই কে বলল তোমাকে? সিনেমায় যেমন দেখো, তেমনটি হয়তো নেই। কিন্তু যারা আছে, তারাও কম হারামী না।
আছে নাকি এদিকে? চিত হয়ে ছিল, কনুয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হলো রবিন।
আছে। জিভারো ইনডিয়ানদের এলাকা এটা।
জিভারো? জিনা মুখ তুলল।
হ্যাঁ, জিভারো। অনেক ইনডিয়ানদের মত ওরাও নরমুণ্ডের ট্রফি রাখে। যদি টের পায় আমরা আছি, চোখের পলকে এসে হাজির হবে। কিছু বোঝার আগেই দেখব আমাদের ঘিরে ফেলেছে।
থাক থাক, আর বলবেন না, হাত নাড়ল মুসা। পরক্ষণেই হয়তো দেখব। বর্শার মাথায় আমাদের কাটা মুণ্ডগুলো শোভা পাচ্ছে! ভয়ে ভয়ে জঙ্গলের দিকে তাকাল সে। আমার রোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ টককো, টকো করে বিচিত্র একটা শব্দ হলো ঝট করে জঙ্গলের দিকে তাকাল ছেলেরা। কিসের শব্দ?
সর্বনাশ, জিভারো! ভীষণ ভয় পেয়েছে যেন চ্যাকো, এমনি ভঙ্গিতে ফিসফিস করে বলল, জঙ্গলের মধ্যে একজন আরেকজনকে সঙ্কেত দিয়ে জানাচ্ছে, শিকার। পাওয়া গেছে।
আবার শোনা গেল টককো টককো। আরও কাছে।
আহ, তোমরা কি শুরু করলে? মৃদু ধমক দিল জিম। খামোকা ভয় দেখাচ্ছ ছেলেগুলোকে!
খামোকা ভয়? জিমের কথা বুঝতে পারল না মুসা।
জিভারো না ঘোড়ার ডিম, ওরটেগার শয়তানী:.. কথাটা শেষ করল না জিম। এই, কম্বল খোলো। শোয়া দরকার।
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! মুসার মত জিনাও অবাক। শব্দ তো একটা হয়েছে। সবাই শুনেছি আমরা। শয়তানীটা কিসের?
ভেনট্রিলোকুইজম! বুঝে ফেলেছে কিশোর। ওরটেগা এই বিদ্যে জানে। আমাদের ভয় দেখানোর জন্যে সে-ই করেছে ওই শব্দ।
ও, এই ব্যাপার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল মুসা। বুকে ফুঁ দিতে দিতে বলল, ইস, কি ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিলেন।
কম্বলের বাণ্ডিল খুলছে ওরটেগা। শব্দ করে হাসল।
চ্যাকোও হাসল।
কম্বল খোলা শেষ হলে ওরটেগা ডাকল, এসো, শুয়ে পড়া যাক।
এক মিনিট, বাধা দিয়ে বলল জিম। একজনকে পাহারায় থাকতে হবে। পালা করে পাহারা দেব। ওরটেগা, শুরুতে তুমি থাকো। মাঝরাতের দিকে আমাকে তুলে দিয়ো। শেষরাতে আমি চ্যাকোকে তুলে দেব।