অপরূপ সে সৌন্দর্য থেকে জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে আনতে হলো। একে অন্যের দিকে তাকাল অভিযাত্রীরা, নীরবে। লোকালয়ের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। জীবনের সাড়া নেই। চারপাশে গাছপালার বিস্তারের মাঝে এমন জায়গায় হারিয়েছে। ওরা, পথ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
বললাম না, ভাল আটকান আটকেছি, তিক্ত কণ্ঠে বলল চ্যাকো। বেরোনোর পথ নেই। রেডিও খারাপ, এসওএস পাঠাতে পারব না। খাবার-দাবার যা আছে, খুব তাড়াতাড়িই ফুরিয়ে যাবে। তিন-চারজনের আন্দাজ নিয়েছিলাম, তাতেও বেশি দিন চলত না। তার ওপর আরও তিন-চারটে মুখ যোগ হয়েছে। এমন ভাবে তাকাল সে, কুঁকড়ে গেল ছেলেরা।
কি আছে চ্যাকোর মনে? তাদেরকে এই জঙ্গলে ফেলে চলে যাবে না তো।
ছেলেদের মনের কথা বুঝতে পেরে হাসল জিম, ভয় পেয়ো না। তোমাদের ফেলে যাব না। ভাগাভাগি না হয়ে জোট বেঁধে এই বিপদ থেকে বাঁচার চেষ্টা করব। পরিস্থিতি হালকা করার জন্যে বলল, ধরা যাক, আমরা ভ্রমণকারী, নতুন দেশ আবিষ্কারে বেরিয়েছি। হাহ্-হা।
হাসল বটে জিম, কিন্তু তার চোখের উৎকণ্ঠা দূর হলো না।
নীরবে পাহাড় বেয়ে নেমে আবার ফিরে চলল ওরা।
বাতাসে আর্দ্রতা এত বেশি, অসহ্য মনে হচ্ছে গরম। চটচটে ঘাম, যেন আঠা মাখিয়ে দেয়া হয়েছে শরীরে। অস্বস্তিকর। ঘন ঝোপঝাড়ের দিকে তাকালে গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। মনে হয়, অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে হিংস্র সব নাম-না-জানা। জানোয়ার, যে কোন মুহূর্তে এসে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে।
বিমানে ফিরে দেখল হতাশ হয়ে বসে আছে ওরটেগা।
নাহ, হলো না, দেখামাত্র বলল সে। অনেক সময় লাগবে মেরামত করতে, আদৌ যদি মেরামত হয়। কয়েক দিন এমন কি কয়েক হপ্তাও লাগতে পারে। ততদিনে না খেয়েই মরে যাব।
এত ভেঙে পড়লে চলবে না, জিম বুলল। প্ল্যান করে এগোতে হবে। এখনই বাঁচার আশা ছেড়ে দিলে মরবই তো.। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ, হাল ছাড়ব না। কিছুতেই। উপযুক্ত লোক জিম, নেতা হওয়ার গুণ তার আছে।
প্লেনটা আমাদের হেডকোয়ার্টার, বলল সে। এখান থেকেই আশপাশে অভিযান চালাব, পথ খুঁজে বের করব।
খাবারের কি হবে? মনে করিয়ে দিল মুসা।
হ্যাঁ, ঠিক, কিশোরও বলল, খাবার?
কিছু খাবার তো আছে। ওগুলো থাকতে থাকতে রেডিও ঠিক হয়ে গেলে, বেঁচে যাব।
এরপর কাজে লাগল জিম। সব খাবার বের করে নিজের দায়িত্বে নিল। হিসেব। করে খেতে হবে।
ফুরিয়ে গেলে কি করব? প্রশ্ন করল চ্যাকো।
পানির ভাবনা নেই, বলল জিম। নদীর পানি এনে ভালমত ফুটিয়ে খেলেই অসুখের ভয় থাকবে না। তবে হ্যাঁ, শিকার একটা বড় সমস্যা।
কয়েকটা পিস্তল আর একটা সাব-মেশিনগান ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই হাইজ্যাকারদের কাছে। ফাঁদ পাততে জানে না। বলতে গেলে, জঙ্গলে টিকে থাকার কোন অভিজ্ঞতাই তাদের নেই।
আলাপে কান না দিয়ে নতুন রেডিও মেরামতে মন দিল ওরটেগা। বুঝতে পারছে, তাদের সবার জীবন এখন ওই যন্ত্রটার ওপর নির্ভর করছে, যে ভাবেই হোক সারাতে ওটাকে হবেই। কিন্তু এমন ভাঙা ভেঙেছে, সারানোও খুব কঠিন। কিছু স্পেয়ার পার্টস আছে প্লেনের যন্ত্রপাতির ইমারজেন্সি বক্সে। আর কিছু বদলাতে পারবে অন্যান্য যন্ত্রপাতি থেকে খুলে এনে। কিন্তু তারপরেও ঠিক হবে তো? তেমন ভাল টেকনিশিয়ান নয় ওরটেগা।
কাজ মোটামুটি ভাগ করে নিয়েছে ওরা। চ্যাকো রান্না করে, তাকে সাহায্য করে রবিন আর জিনা। জিমের সঙ্গে শিকারে যায় মসা, পাওয়া যায় না প্রায় কিছুই, তবু রোজ বেরোয়। ওরটেগা রেডিও নিয়ে থাকে, তাকে সহায়তা করে কিশোর। রাফিয়ানও অকেজো থাকে না। শিকারে যায়, রাতে পাহারা দেয়। তার খাবারটা সে অর্জন করেই নেয়।
হাইজ্যাকার আর জিম্মিদের মাঝের ফারাকটা আর নেই, বন্ধু হয়ে গেছে ওরা।
কয়েক দিন চলে গেল, কিন্তু রেডিও ঠিক হলো না। হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল। ওরটেগা, আমার ক্ষমতায় কুলাবে না।
খাবারও ফুরিয়ে এসেছে, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল চ্যাকো। জিম, কিছু একটা করো। আর তো দেরি করা যায় না।
কিছু একটা করা দরকার, তাড়াতাড়ি সবাই একমত হলো এতে। কিন্তু কি করবে। রেডিও অচল, হাইজ্যাকাররা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। বাইরে থেকে সাহায্য আসার কোন আশা নেই। একটাই পথ আছে, বেরিয়ে পড়া। তারপর ভাগ্য ভাল হলে বাচবে, নইলে মৃত্যু। বিকল্প আর কিছু নেই।
খাবার যা অবশিষ্ট আছে গুছিয়ে নেয়া হলো। ফাস্ট-এইড কিট, কয়েকটা কম্বল, রান্নার সরঞ্জাম আর আরও দুয়েকটা টুকিটাকি জিনিস বেধে ভাগাভাগি করে কাঁধে তুলে নিল ওরা, বেরিয়ে পড়ল নিরুদ্দেশ যাত্রায়।
কয়েক দিন প্লেনটাই ছিল তাদের ঘর, এখন ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছে। বার। বার পেছনে ফিরে তাকাল ওরা। আর যাই হোক, নিরাপদ আশ্রয় তো অন্তত ছিল।
ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল দলটা, সাতজন মানুষ আর একটা কুকুর। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল ইয়াপুরার তীরে।
কিশোর পরামর্শ দিল, নদী ধরেই এগোনো যাক। খাবার আর গোসলের পানি পাব। সবচে বড় কথা, পথ হারানোর ভয় থাকবে না। নদীর ধারে মানুষের বসতি থাকার সম্ভবনাও বেশি।
সবাই রাজি হলো। নদীর ধার ধরেই এগোল ওরা।
খোলা চরা, গাছপালার ছায়া নেই। কড়া রোদ। ভীষণ গরম। দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ল সকলে। ঝামেলা বাড়াল রবিন। একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে পায়ে ব্যথা পেল। ওই পা-টা অনেক দিন আগে একবার ভেঙেছিল পাহাড়ে চড়ার সময়, আবার চোট লাগল ওটাতেই। খোঁড়াতে শুরু করল সে।