আরও কয়েক মুহূর্ত কেউ নড়ল না!
সবার আগে সামলে নিল জিনা। না না, ভুল হলো, রাফিয়ান। তাকে কোলে নিয়ে দুহাতে আঁকড়ে ধরে রেখেছে জিনা। তার গাল চেটে দিল কুকুরটা। লেজ নেড়ে চেঁচিয়ে উঠল, খউ! খউ!
রাফি, সব ঠিক হয়ে গেছে, না? দুর্বল লাগছে জিনার, সারা শরীর কাঁপছে। রাফিয়ানকে ছেড়ে দিয়ে কাঁপা হাতে বেল্ট খুলল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, আলো নিভে গেছে। অন্যেরা ঠিক আছে তো?
এই সময় সাড়া দিল মুসা, আল্লাহরে! দুনিয়ায় আছি, না দোজখে?
মুসা, তুমি ভাল আছ? উৎকণ্ঠায় ভরা জিনার কণ্ঠ।
তা আছি। তবে দুনিয়াতে, না আল্লাহর কাছে, বুঝতে পারছি না। তুমি?
দুনিয়াতেই আছ। আমি ভাল। কিশোর আর রবিনের কি খবর?
ওরাও সাড়া দিল, ভাল। তবে পুরোপুরি অক্ষত কেউই নয়, কমবেশি আহত হয়েছে সবাই। কারও চামড়া ছড়েছে, কেউ কনই কিংবা হাটুতে ব্যথা পেয়েছে।
অন্ধকারে চ্যাকো আর ওরটেগার কথা শোনা গেল। ওরাও ঠিকই আছে বোঝা গেল। কিন্তু জিমের কি অবস্থা?
ককপিটে গিয়ে ঢুকল তার দুই সহকারী। জিমের নাম ধরে ডাকল চ্যাকো। সাড়া নেই। বিড়বিড় করে কিছু বলে একটা টর্চ খুঁজে বের করে জ্বলল।
কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর ঝুঁকে পড়ে রয়েছে জিম। দ্রুত পরীক্ষা করে দেখল ওরটেগা। না, মরেনি, বেহুশ হয়ে গেছে।
কপাল কেটেছে। বাড়ি খেয়েছে ভালমতই।…এই যে, হুশ ফিরছে।
চোখ মেলল জিম, আপনাআপনি হাত চলে গেল কপালের কাটায়। প্লেন অনড় হয়ে রয়েছে বুঝতে পেরে হাসল, পেরেছি তাহলে।
হ্যাঁ, পেরেছেন, পেছন থেকে বলে উঠল কিশোর। ওরাও এসে ঢুকেছে। ককপিটে। দারুণ দেখিয়েছেন। আগুন ধরছে না কেন এখনও?
আর ধরবেও না। ভাগ্য ভাল আমাদের। ধরলে নামার সময় ধাক্কা যখন লেগেছে, তখনই ধরে যেত।
প্লেনের বিশ্বাস নেই, নিশ্চিন্ত হতে পারছে না জিনা। ধরে যেতেও পারে। চলুন বেরিয়ে যাই।
না, ধরবে না, বলল জিম। বাইরে যাব কোথায়? যা অন্ধকার, আর জঙ্গল। কি বিপদ রয়েছে কে জানে। তার চেয়ে এখানেই আপাতত নিরাপদ। ভোরে উঠে বেরোব। তখন দেখব কোথায় পড়েছি, কিভাবে উদ্ধার পাব।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, একমত হলো কিশোর।
খুঁজে ফাস্ট-এইড কিট বের করল জিনা। জিমের কপালের রক্ত পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল।
সীটগুলোকে মেলে বিছানা বানিয়ে শুয়ে পড়ল সবাই। ঘুমাতে পারলে ভাবনা। অনেকখানি দূর হবে, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারবে। তাছাড়া যা ধকল গেছে সারাটা দিন, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর।
কিন্তু নরম গদিতে আরামে শুয়েও সহজে ঘুম আসতে চাইল না। নানারকম। ভাবনা ভিড় করে আসছে মনে।
সবার আগে ঘুম ভাঙল মুসার। বাইরে উজ্জল দিন, জানালা দিয়ে আলো আসছে। আশেপাশে চেয়ে দেখল, তার বন্ধুরা সবাই ঘুমিয়ে আছে। তিন হাইজ্যাকারের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কেটে পড়ল নাকি?
রেডিওর কাছ থেকে শোনা গেল ওরটেগার গলা, যন্ত্রটাকে গালমন্দ করছে। খারাপ হয়ে গেছে বোধহয়, চালু করতে পারছে না। টু শব্দও তো করছে না। করি কি এখন?
এই সময় হাজির হলো জিম আর চ্যাকো। বাইরে বেরিয়েছিল। চেহারা দেখেই বোঝা গেল, খবর ভাল না।
কিশোর, জিনা আর রবিনেরও ঘুম ভাঙল। ভুরু কুঁচকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে জিমের দিকে তাকাল জিনা।
খালি জঙ্গল, জানাল জিম। তবে এই জঙ্গলই বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের। কাদামাটি বেশি, জলাভূমিই বলা চলে। কলামবিয়ার বর্ডার থেকে দূরে, ইয়াপুরার কাছে রয়েছি, আমাজন এলাকার মধ্যে। সভ্যতা অনেক দূর। ওরটেগা, রেডিওর, খবর কি? কাজ করছে?
না, ফিসফাসও করে না। ভাল আটকান আটকেছি। এ-থেকে বেরোতে পারব কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।
কাছেই একটা ছোট পাহাড় আছে, রুক্ষ কণ্ঠে বলল চ্যাকো। টিলা বলাই ভাল। ওতে চড়ে দেখা দরকার, কোন দিকে কি আছে। তারপর ঠিক করা যাবে। কি করব।
চলো, আমিও যাচ্ছি তোমার সঙ্গে, জিম বলল।
আমরা আসি? অনুরোধ করল কিশোর। হাত-পা সব শক্ত হয়ে গেছে, একটু নাড়াচাড়া দরকার।
হাত নাড়ল জিম। ক্ষতি কি? এসো।
ওরটেগাকে রেডিওর কাছে রেখে বাকি সবাই নেমে এল বিমান থেকে।
.
০৪.
দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল ছেলেরা।
এমন জঙ্গল আর কখনও দেখেনি। বড় বড় গাছ, এত উঁচু আর এমনভাবে ডালপালা ছড়িয়েছে, সূর্যের আলো ঢুকতে পারে না ঠিকমত। পায়েরতলায় ভেজা। নরম মাটি, জলাভূমি বলা না গেলেও কাদাভূমি বলা চলে। তার ওপর সবুজ। শ্যাওলা। কাদায় পা দেবে যায়। সাবধানে চলতে হচ্ছে। কে জানে কোথায়। ঘাপটি মেরে রয়েছে চোরাকাদার মরণফাঁদ।
কিছুক্ষণ হাটার পর মাটি শক্ত হয়ে এল।
যে পাহাড়টার কথা বলেছে চ্যাকো, আসলেই ওটাকে টিলা বলা উচিত গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে খুব সামান্যই উঠেছে। পাথুরে, খুদে কৃত্রিম পর্বত যেন রাফিয়ান পাহাড়ে চড়তে পারে না বিশেষ, কিন্তু এটাতে চড়তে তারও অসুবিধে হলো না।
চুড়াটা চোখা নয়, বিশাল ছুরি দিয়ে পোঁচ মেরে কেটে ফেলা হয়েছে যেন, সমান। দাঁড়ানোর চমৎকার জায়গা। নিচে তাকিয়ে অবাক না হয়ে পারল না ওরা। অস্ফুট শব্দ করে ফেলল কেউ কেউ। ঠিক যেন তাদের পায়ের নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে ইয়াপুর নদী, পুবে। নদীর দুই তীরে চওড়া চরা, হলুদ বালি চিকচিক করছে। রোদে। তিন কিলোমিটার মত উঁচু উঁচু পাথরের চাইয়ের মাঝে ঢুকে হারিয়ে গেছে। নদীটা। তার পরে ছড়িয়ে রয়েছে পাহাড় শ্রেণী, মহান অ্যাণ্ডিজের বিশাল পার্বত্য এলাকা।