সংবাদটা বিশেষ আশাব্যঞ্জক মনে হলো না ছেলেদের কাছে, কিন্তু কি আর করা। এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
রাত নামল। জিনা বলল, এসো, ঘুমাই। দুশ্চিন্তা কমবে।
কেবিনের সীটে বসে ঘুমানোর চেষ্টা করল ওরা।
সবাই ঘুমাল, কিন্তু জিনার চোখে ঘুম নেই। রাফিয়ানের কথা ভাবছে। কয়েকবার চ্যাকোকে অনুরোধ করেছে সে, রাফিয়ানকে কেবিনে নিয়ে আসার। জন্যে। রাজি হয়নি চ্যাকো, কুকুর পছন্দ করে না।
সামনের দিকে একটা সীটে চ্যাকোর নাক ডাকার শব্দ শোনা গেল।
নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল জিনা। চুপি চুপি চলল কেবিনের পেছন দিকে।
তখন প্লেনের পেছনের দরজা দিয়ে উঠেছিল রাফিয়ানের কামরায়। এদিকের পথ চেনে না। কিন্তু থামল না জিনা। একের পর এক দরজা খুলে উঁকি দিতে লাগল ভেতরে। ভাড়ারটা পেল। চ্যাকো বলেছে, ভাঁড়ারের সঙ্গেই রয়েছে জন্তু জানোয়ারের ঘর।
কি করে জানি টের পেয়ে গেল রাফিয়ান, জিনা কাছাকাছি রয়েছে। বোধহয় গন্ধ পেয়েছে। চাপা গোঁ গোঁ করে উঠল সে।
দরজা খুলে ছুটে গিয়ে রাফিয়ানের গা ঘেঁষে বসে পড়ল জিনা। পিঠে হাত বুলিয়ে, মাথায় আলতো চাপড় দিয়ে আদর করতে লাগল। রাফি, কষ্ট পাচ্ছিস? তোর তো পাওয়ার কথা না। আরামেই আছিস। আমরাও অবশ্য খুব একটা খারাপ নেই, হাইজ্যাকাররা লোক ভাল। বুঝলি রাফি, এবার আর কোন রহস্যের সমাধান নয়। অ্যাডভেঞ্চার, পিওর অ্যাডভেঞ্চার।
হউ! লেজ নেড়ে বলল রাফিয়ান, একমত হলো যেন জিনার কথায়। হউ! হউ!
রাফিয়ানের মুখের দিকে তাকাল জিনা। ঠিক বলেছিস। অ্যাডভেঞ্চার মানেই অ্যাকশন। দাঁড়া, আগে নেমে নিই। তোর সাহায্যে হাইজ্যাকারদের ফাঁকি দিয়ে পালাব আমরা। ও হ্যাঁ, কিশোর, মুসা আর রবিনও আছে। আমাদের ছেড়ে যায়নি।
হউ! বলল আবার রাফিয়ান।
কুকুরটার বাঁধন খুলে দিল জিনা। তাকে নিয়ে ফিরে এল কবিনে। কিন্তু নিজের সীটে পৌঁছার আগেই ভীষণভাবে দুলে উঠল বিমান। তাল সামলাতে না পেরে, উল্টে পড়তে পড়তে একটা সীট খামচে ধরে সামলে নিল সে কোনমতে।
হলো কি? সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল জিনা।
জেগে গেছে চ্যাকো। লাফিয়ে উঠল।
ধাক্কার চোটে তিন গোয়েন্দাও জেগে গেল।
আবার কেঁপে উঠল বিমান, গা ঝাড়া দিচ্ছে যেন দুরন্ত ঘোড়া।
ককপিটের দিকে ছুটল চ্যাকো। ছেলেরা পিছু নিল।
রেডিওর কাছ থেকে উঠে গিয়ে জিমের পাশে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে ওরটেগা, নজর কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে। নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে জিম।
কি হলো? জিম উদ্বিয়।
ফিরে তাকাল না জিম। এই সময় আবার কেঁপে উঠল প্লেন, প্রচণ্ডভাবে। সামান্য কাত হয়েই আবার সোজা হলো। কি জানি, বুঝতে পারছি না, দাঁতে দাঁত চেপে রেখেছে সে। কিছু একটা…
কথা শেষ করতে পারল না, দুলে উঠল বিমান ভীষণভাবে।
সোজা করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা চালাল জিম, কিন্তু এবার আর ঠিক হতে চাইছে না বিমান। গোলমাল একটা কিছু হয়েছে। কি, বুঝতে পারছি না। চালানোয় কোন ভুল হয়নি আমার।
চ্যাকো আর ওরটেগার মুখ কালো। নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেছে যেন ছেলেরা। রাফিয়ানও উদ্বিগ্ন, অদ্ভুত কোন উপায়ে টের পেয়ে গেছে বিপদ।
মরব না তো, জিম? ওরটেগার গলা কাঁপছে। নামাতে পারবে তো?
কন্ট্রোল কথা শুনতে চাইছে না, জিম জানাল। খারাপের দিকেই যাচ্ছে। জোর নেই গলায়। জাদ তো আর জানি না, অলৌকিক কিছু ঘটাতে পারব না।
ঝাঁকুনি দিয়ে নাক নিচু করে ফেলল প্লেন। গাঢ় অন্ধকারে শা শা করে মাটির দিকে ছুটে চলল।
চুপ করে রয়েছে ছেলেরা। রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে। নিজেদের অজান্তেই একে অন্যের হাত ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন শক্তি সঞ্চয় করছে। রাফিয়ান জিনার পা ঘেষে রয়েছে।
কন্ট্রোলের ওপর আরও ঝুঁকে গেছে জিম। তার দুপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে চ্যাকো আর ওরটেগা, আতঙ্কিত।
মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পেরোল, কিন্তু ওদের মনে হলো, কয়েক যুগ।
অবশেষে মাথা সোজা করল জিম। জলদি গিয়ে সীটে বসে সীট-বেল্ট বাধা। ক্র্যাশ-ল্যাণ্ড করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না। চলেছে জঙ্গলের ওপর দিয়ে, নামতে পারলে হয় এখন, গোপন না করে সত্যি কথাই বলল সে।
সবাই বুঝল, বাঁচার আশা কম।
আরে, মুখ অমন কালো করে রেখেছ কেন? হাসার চেষ্টা করল কিশোর, সীট-বেল্ট বাধছে। আগেও বিপদে পড়েছি, উদ্ধারও পেয়েছি, নাকি?
কই কালো কই? এই তো হাসছি, কিন্তু জিনার হাসিটা কান্নার মত দেখাল।
সাধ্যমত চেষ্টা করছে জিম। অলটিমিটারের ওপর চোখ, প্লেনের নাক সোজা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সোজা হলে গতি অন্তত সামান্য কমবে, তাতে নাক সোজা করে মাটিতে গিয়ে গাঁথবে না প্লেন।
কিন্তু কথা শুনল না প্লেন, খামখেয়ালির মত চলেছে। নাক তো সোজা করলই, বিপদ আরও বাড়ানোর জন্যেই যেন বিপজ্জনক ভঙ্গিতে কাত হয়ে গেল। একপাশে। কোথায় যাচ্ছে, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না জিম।
পাহাড়-টাহার নেই তো? তাহলে আর কিছুই করার থাকবে না। পাহাড়ের ধাক্কা খেলে আর ভাবতে পারল না সে।
পরের কয়েকটা মুহূর্ত ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের মাঝে কাটল যেন ওদের। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সামনে ঝুঁকে গেল সবাই, টান টান হয়ে গেল সীট-বেল্ট। আরও কাত হয়ে পুরো আধচক্কর ঘুরল বিমান, সোজা হলে সামান্য, পরক্ষণেই তার ধাতব শরীর ছেঁড়ার তীক্ষ্ণ চড়চড় শব্দ কানে এল। আরেকবার প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল নাক নিচে, লেজ ওপরে তুলে।