অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল জিনা। যে কোন মুহূর্তে রিও ছাড়বে প্লেন, একা হয়ে যাবে তখন। বন্ধুদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। হঠাৎ করেই মনে পড়ল। রাফিয়ানের কথা। আছে তো, না তাকেও নামিয়ে দিয়েছে? রাফিয়ান সঙ্গে থাকলে অনেক ভরসা পায় জিনা, বিপদে-আপদে সাহায্য পাবে।
জানালা দিয়ে দেখছে জিনা, বাইরে সবাই ব্যস্ত। অসংখ্য পুলিশ ঘিরে রেখেছে। প্লেনটাকে, কিন্তু বিষদাত ভাঙা সাপের অবস্থা হয়েছে ওদের, কিছুই করতে পারছে। না। অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্লেনে তেলভরা দেখছে শুধু।
বিমানের কর্মচারী আর যাত্রীরা ঢুকে যাচ্ছে এয়ারপোর্টের মেইন বিল্ডিঙে, তাদেরকে ঘিরে রয়েছে এক ঝাঁক রিপোর্টার। নিশ্চয় তাদের মাঝেই রয়েছে, কিশোর, মুসা আর রবিন।
আচ্ছা, কিশোর কি করছে? এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার ছেলে তো সে নয়। ক্ষীণ আশা হলো জিনার, কিশোর যখন মুক্ত রয়েছে, কিছু একটা সে করবেই। জিনাকে উদ্ধার করার সব রকম চেষ্টা চালাবে, বুদ্ধি একটা ঠিক বের করে ফেলবে।
মুসা আর রবিনের কথা ভাবল। কি একেক জন সোনার টুকরো ছেলে। তাকে বাঁচানোর জন্যে স্বেচ্ছায় নিজেদেরকে বিপদে ঠেলে দিতে চেয়েছিল। আর সে কিনা ওদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, সারাক্ষণ ঝগড়া বাধিয়ে রাখে।
বাবা-মার কথা মনে পড়তেই চোখে পানি এসে গেল জিনার। তারা ওকে কত ভালবাসেন, অথচ সে খারাপ ব্যবহার করে তাদের সঙ্গে। সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে। ফেলল জিনা, আর কারও সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করবে না। ভাল হয়ে যাবে। কিন্তু ভাল হওয়ার কথা তো পরে, আগে এখান থেকে বেরোতে তো হবে। মুক্তি পেলে তবে না…
ককপিটে ঢুকল চ্যাকো, তার পেছনে ওরটেগা।
এবার যাওয়া যায়, জিম, চ্যাকো বলল।
রানওয়েতে চলতে শুরু করল প্লেন। দুরুদুরু করছে জিনার বুক। সময় অনেক দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
অবশেষে মাটি ছাড়ল প্লেন, দ্রুত ওপরে উঠতে লাগল।
জিম ঘোষণা করল, অলটিচিউড বারো হাজার মিটার। স্পীড এক হাজার কিলোমিটার।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল চ্যাকো আর ওরটেগা।
সেরে দিলাম কাজ! হাসি ফুটল ওরটেগার মুখে। নিরাপদ। জিনাকে ধন্যবাদ। ওর জন্যেই কেউ পিছু নিতে সাহস করবে না।
জিনাকে বলল চ্যাকো, ইচ্ছে করলে ঘোরাঘুরি করতে পারো। বলেছি না, তোমার কোন ক্ষতি করব না।
কেবিনের দরজা খুলে দিল সে।
জিনা বেরোল। চেঁচিয়ে উঠল, তোমরা! তোমরা এখানে।
চিৎকার শুনে দরজায় উঁকি দিল চ্যাকো। তাজ্জব হয়ে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সেই ছেলে তিনটে, জিনার বন্ধু। বোধহয় সীটের নিচে। লুকিয়ে ছিল এতক্ষণ। বেশ খুশি খুশি লাগছে ওদের।
যাওনি? কেবিনে নামল চ্যাকো।
নাহ, যেন কিছুই না এমনি ভঙ্গিতে বলল কিশোর। জিনাকে দেখিয়ে বলল, ও রয়ে গেছে। ফেলে যাই কি করে?
ছিলে কোথায়?
সীটের নিচে।
হু, এত ব্যস্ত ছিলাম, গুণে দেখার কথা মনে হয়নি। তাছাড়া ভাবতেও পারিনি, ঝুঁকি নিয়ে কেউ রয়ে যাবে প্লেনে। শুধু বন্ধুর সঙ্গে থাকার জন্যেই রয়ে গেলে?
একসঙ্গে বেরিয়েছি, রবিন বলল, একসঙ্গে যাব। বিপদের মোকাবেলা করতে। হলেও একসঙ্গেই করব। একা রেখে গেলে ওর বাপ-মাকে গিয়ে কি জবাব দেব?
প্রশংসা ফুটল চ্যাকোর চোখে। কাজটা বোধহয় ভাল করলে না। যাকগে, আমাদের কি? ঝামেলা বাড়ল বটে, কিন্তু সুবিধেও হলো। নিজেকে বোঝাচ্ছে সে। একজন জিম্মির চেয়ে চারজন
পাঁচ, শুধরে দিল জিনা। যদি রাফিয়ানকে নামিয়ে না দিয়ে থাকেন?
রাফিয়ান? কুঁচকে গেল চ্যাকোর ভুরু।
আমার কুকুর। আপনার সঙ্গে যে ধাক্কা লাগল, ওকেই তখন দেখতে গিয়েছিলাম। আপনি গিয়েছিলেন কেন?
হাসল চ্যাকো। জানোয়ারের ঘরের পাশেই বিমানের ভাড়ার। অস্ত্রপাতিগুলো ওখানেই রেখেছিলাম।
আর কিছু না বলে ককপিটে চলে গেল সে। জিম. আর ওরটেগাকে খবরটা জানানোর জন্যেই হয়তো।
কিশোরের হাত ধরল এসে জিনা। থ্যা-থ্যাংকিউ..
খাইছে! বলে উঠল মুসা। যেন শুধু কিশোরই থেকেছে। আমরা থাকিনি?
হাসল জিনা মুসা আর রবিনেরও হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিল। ধন্যবাদ দিল বার। বার। ওরা রয়ে যাওয়ায় সে কৃতজ্ঞ বোধ করছে, জানাল নির্দ্বিধায়।
সহজ হয়ে গেল পরিবেশ।
পরের কয়েক ঘণ্টায় হাইজ্যাকারদের সঙ্গেও সম্পর্ক সহজ করে নিল চার। অভিযাত্রী। বাবুর্চি আর স্টুয়ার্ডের দায়িত্ব নিল চ্যাকো। ট্রেতে খাবার সাজাতে গিয়ে ভুলভাল করে ফেলল। হেসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল রবিন। দুজনে মিলে খাওয়া সরবরাহ করল সবাইকে।
জিমের পাশে খাবারের ট্রে নামিয়ে রাখল রবিন।
থ্যাংকস, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে জিম। অন্ধকার হয়ে যাবে। শিঘ্রী। তখন আর খেতে পারব না। এতবড় প্লেন এর আগে কখনও চালাইনি তো, সারাক্ষণ সতর্ক থাকতে হচ্ছে।
তিনজনের কাজ একা করছ, আর কি? সাহস দিল ওরটেগা। ভালই তো চালাচ্ছ।
আরও কয়েক ঘণ্টা লাগবে, চ্যাকো বলল। পারবে তো?
চেষ্টা তো করতেই হবে, বলল জিম। রেডিওতে যোগাযোগ করতে হবে ওদের সঙ্গে। নামার নির্দেশ চাইব। না না, এখন না, আরও অনেক পরে।
আমাদের কখন যেতে দেবেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর। আমাজনের ওদিকে তো ঘোর জঙ্গল। সভ্য লোকালয় আছে?
ভেব না, জবাব দিল ওরটেগা। জঙ্গলের মাঝে মিশনারিদের ক্যাম্প আছে। ওখানে দিয়ে আসব। ওরাই তোমাদের পৌঁছে দেবে লোকালয়ে।