সীটের মাঝের গলিপথে আর কেবিনের পেছনে স্থির হয়ে আছে স্টুয়ার্ড স্টুয়ার্ডেসরা। ওরটেগারের কাছে দাঁড়ানো একজন স্টুয়ার্জেসের কাছে এগিয়ে গেল গ্যাকো। পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, হাঁটো।
বাথরুম আর রান্নাঘরে বিমানের সমস্ত কর্মচারীদের আটকে রেখে এল হাইজ্যাকাররা। তারপর জিম চলে গেল ককপিটে।
চালাতে পারবে তো? বিদ্রুপের হাসি ফুটল ওরটেগার ঠোঁটে। কিশোর বুঝল ওরকম করেই হাসে লোকটা।
পারবে তো বলল, জবাব দিল চ্যাকো।
পারলে ভাল। আমাদের জীবন এখন ওর হাতে। হালকা টুরিস্ট প্লেন ছাড়া। আর তো কিছু চালায়নি। এতবড় প্লেন সামলাতে পারলে হয়।
কড়া চোখে তাকাল চ্যাকো। বেশি কথা বলো। জিম যখন বলেছে চালাতে পারবে, পারবেই। খামোখা ভয় দেখাচ্ছে বাচ্চাগুলোকে।
হাইজ্যাকারদের ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না জিনা। রোমাঞ্চ ভাল লাগে তার। ভয় পায়নি। অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধে রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
প্রথম চমকটা কেটে গেছে। শত্রুদের ভালমত লক্ষ করছে এখন জিনা। চ্যাকোকে শুরুতে ভাল লাগেনি তার, নিষ্ঠুর মনে হয়েছে, কিন্তু এখন যতখানি খারাপ লাগছে না। আসলে দেখে যতটা মনে হয়, তত খারাপ নয় বিশালদেহী লোকটা.।
একটু আগের কথা কাটাকাটির কথা বেমালুম ভুলে গেল জিনী, আস্তে করে কনুই দিয়ে গুতো দিল মুসার গায়ে। কি ভয় পাচ্ছ?
ভয়? হ্যাঁ, তা-তো পাচ্ছিই। কি ঘটে কিছুই বলা যায় না।
কি মনে হয়? দারুণ একখান অ্যাডভেঞ্চার হবে, না?
তোমার কাছে দারুণ লাগছে। আমার সুবিধের মনে হচ্ছে না। হাইজ্যাকারদের বিশ্বাস নেই। আর আমরা এখানে ভাল থাকলেই কি? বাবা-মা চিন্তা করবে না?
মুসা ঠিকই বলেছে, পেছন থেকে বলল কিশোর। রেডিও অপারেটরকে বেঁধে রেখেছে। রিওর কন্ট্রোল টাওয়ার নিশ্চয় যোগাযোগের চেষ্টা করছে প্লেনের সঙ্গে। জবাব পাবে না।
হ্যাঁ, রবিন একমত হলো। হাইজ্যাকের খবর সব সময়ই খবরের কাগজের হেডলাইন হয়। খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়বে খবর। বাবা, মা, সাংঘাতিক দুশ্চিন্তা করবে।
আচ্ছা, শেষ পর্যন্ত ওরা কি করবে বলো তো? জিনা বলল। ইস, রাফিয়ান এখন এখানে থাকলে হত। ওরটেগা আর চ্যাকোকে কাবু করে ফেলতে পারতাম। আবার সব ঠিক হয়ে যেত।
জবাব দিল না তিনজনের কেউ।
বেশি অবাস্তব কল্পনা করছে জিনা। কিন্তু কিশোর আন্দাজ করতে পারছে, কতখানি বিপদে পড়েছে ওরা। প্লেনের সমস্ত কর্মচারী আর যাত্রী এখন হাইজ্যাকারদের হাতের পুতুল, যেভাবে বলা হবে, সেভাবেই কাজ করতে হবে।
ছেলেমেয়েদের গুঞ্জনে মনে হচ্ছে, হাজার হাজার মৌমাছি এনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে কেবিনে। কেউ আস্তে কথা বলছে, কেউ জোরে। বেশি বাচ্চা কয়েকজন। ফোপাচ্ছে নিচুস্বরে, থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই।
সব আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা গেল চ্যাকোর কর্কশ কণ্ঠ, এই, চুপ! শুনছ? চুপ! শোনো, আমার কথা শোনো।
থেমে গেল গুঞ্জন।
তোমাদের কারও কিচ্ছু হবে না, বলল চ্যাকো। কি করব, সেটা পরে বলছি। কেন করেছি সেটা আগে শোনো। প্লেনটা আমাদের দরকার। কিছু মাল। নিরাপদে কলাম্বিয়ায় পার করতে চাই। কাস্টমস গোলমাল করবে, তাই….
সোজা করে বলো না, বাধা দিয়ে বলল ওরটেগা, কিছু মাল স্মাগল করব আমরা।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল বাচ্চাদের। শুধু হাইজ্যাকারই নয়, চোরাচালানীর পাল্লায় পড়েছে ওরা।
টাকা নেই আমাদের, বলে গেল চ্যাকো। ভাড়ার পয়সাও নেই। ভাবলাম, একটা প্লেন হাইজ্যাক করতে পারলে কাজ হয়। ঝুঁকিটা নিয়েই ফেললাম। তিনজন কেয়ার টেকারের কাগজপত্র জাল করে তার বদলে আমরা উঠেছি, আসল লোকেরা রয়ে গেছে নিউইয়র্কে, এয়ারপোটে এক বাথরুমে, আটক। তাই কোন অসুবিধে হয়নি। সন্দেহ হয়নি কারও। বুঝতে পারছি, সফল হব, তবে তার জন্যে তোমাদের সহায়তা দরকার।
বাহ, বড় বেশি আত্মবিশ্বাস দেখছি, বলে উঠল হেনরিক। আমাকে আটকাওনি কেন?
তোমাকে এখানে দরকার ছিল। কেয়ারটেকারের ট্রেনিং আছে তোমার, আমাদের নেই। সবাই আনাড়ি হলে মুশকিল। ধরা পড়ে যেতাম, বলল ওরটেগা।
নতুন কাজ নিয়েছি ওই ট্র্যাভেল এজেন্সিতে, বলল হেনরিক। এ-লাইনে। এটাই প্রথম সফর। অন্য তিনজনকে চিনি না বলেই করতে পারলে।
সেজন্যেই তো তোমাকে বেছে নিয়েছি, দরাজ হাসি হাসল চ্যাকো। যাকগে। ছেলেরা, যা বলছিলাম। রিওতেই নামব আমরা।
রিও ডি জেনিরোতে প্লেন নামলে বাঁচার কোন উপায় হয়েও যেতে পারে, ভাবল মুসা।
নামব, বলে যাচ্ছে চ্যাকো, প্লেনের তেল নেয়ার জন্যে। আর কিছু খাবারও দরকার আমাদের। কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে কথা বলছে ক্যাপটেন, আমাদের কি কি দরকার, জানাচ্ছে। নেমে সব তৈরিই পাব আমরা। এখন আসছি আসল কথায়। শুধু বিমানটা দরকার আমাদের। এর স্টাফ আর যাত্রীদের নামিয়ে দেয়াই বরং আমাদের জন্যে নিরাপদ, ঝামেলা অনেক কমে যাবে।
ওরটেগা হয়তো ভাবল, এরপরের বিশেষ কথাগুলো তার নিজের বলা দরকার, তাই চ্যাকোর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, কাজেই, তোমাদের কোন ভয় নেই। তোমরা গোলমাল না করলে আমরাও করব না। নামিয়ে দেব জায়গামত।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যাত্রীরা। গুঞ্জন শুরু হলো।
নিচু কণ্ঠে বন্ধুদের বলল মুসা, ব্যাটারা পাগল, বদ্ধ উন্মাদ! যাত্রীদেরকে নামিয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লেনে উঠবে পুলিশ।
আমার তা মনে হয় না, কিশোর বলল। এত সহজ নয় ব্যাপারটা। এসব ভাবেনি, এত বোকা নয় ওরা। কোন মতলব নিশ্চয় আছে।