নিমেষে স্তব্ধ হয়ে গেল কোলাহল।
বন্দিদের আরও কাছে আসার ইশারা করল ওঝা।
সময় উপস্থিত। সবাই উত্তেজিত। চোখ মঞ্চের দিকে।
জনতা যাতে শুনতে পায় সে জন্যে চেঁচিয়ে বলল ওঝা, হে সম্মানিত দেবী, শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?
ছেলেদের বুকের কাঁপুনি বেড়ে গেল। ঠিকমত বলতে পারবে তো ওরটেগা? পণ্ড করে দেবে না তো সব?
হঠাৎ শোনা গেল কথা, কাঁপা কাঁপা কথা। পুরুষ কণ্ঠ, না মহিলা, বোঝা গেল না। মনে হলো, দেবীর অনড় ঠোঁটের কাছ থেকেই এল কথাগুলো, হ্যাঁ, শুনছি।
অস্ফুট শব্দ করে উঠল জনতা, শব্দের একটা শিহরণ বয়ে গেল যেন। শ্রদ্ধায় আপনাআপনি মাথা নিচু হয়ে গেল জিভারোদের।
হে সম্মানিত দেবী, আবার বলল ওঝা, ওই তিনজন মানুষকে চিনতে পারছেন?
জবাব এলঃ নিশ্চয় পারছি! রাগান্বিত মনে হলো দেবীর কণ্ঠ।
পরস্পরের দিকে তাকাল ছেলেরা। ভালই অভিনয় করছে ওরটেগা। উতরে। যাবে মনে হচ্ছে।
ওঝা বলল, সর্দার হামু তাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চায়। আপনিও কি তাই চান?
জবাব ও নিশ্চয়। মৃত্যুদণ্ডই তাদের একমাত্র শাস্তি।
চমকে উঠল ছেলেরা। বলে কি ওরটেগা? দিল নাকি সব গড়বড় করে?
ভাবার সময় পেল না, তার আগেই শোনা গেল আবার ওঝার প্রশ্ন, মৃত্যু কিভাবে হবে তাদের বলুন, হে সম্মানিত দেবী।
দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবতা। মনস্থির করে নিচ্ছে যেন দেবী। জিভারোদের উত্তেজনা চরমে, নিশ্বাস ফেলতে যেন ভুলে গেছে তারা।
অবশেষে শোনা গেল দেবীর রায়ঃ
স্বর্গে গিয়ে হবে তাদের মৃত্যু। দেবতা কালম-কালুম নিজের হাতে বলি দেবেন তাদের। প্রচণ্ড ঝড় বইবে তখন সমস্ত পৃথিবী জুড়ে। পাপীরা ধ্বংস হবে, দেবতার পূজারিরা হবে পুরস্কৃত। তিন বন্দিকে সঙ্গে করে স্বর্গে নিয়ে যাবেন ওঝা বিটলাঙগোরগা।
রায় শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল ইনডিয়ানরা। কি সাংঘাতিক পাপী ওই তিনজন। দেবতা নিজের হাতে বলি দেবেন, তার মানে মৃত্যুর পরেও তাদের পাপ মোচন। হবে না, নরকে জ্বলেপুড়ে মরবে। হাজার রকম শাস্তি পাবে।
তাছাড়া দেবী বলেছেন, সেদিন পাপীরা ধ্বংস হবে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল জিভারোরা। দেবীকে বার বার প্রণাম করল। বাঁচাও দেবী, তোমার পাপী বান্দাকে ছেড়ে দাও কালুম-কালুম, এমনি নানারকম গুঞ্জন।
হাত তুলল ওঝা।
চুপ হয়ে গেল গুঞ্জন।
রায় দিয়েছেন দেবী, বলল ওঝা। সবাই শুনেছ?
চিৎকার করে জানাল সবাই, শুনেছে।
হামু বলল, সম্মানিত বিটলাঙগোরগা, কালুম-কালুমের আদেশ তো শুনলে। বন্দিদেরকে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে?
নিশ্চয়, বলল ওঝা। দেবতার আদেশ অমান্য করতে পারি? সর্দার হামু, তোমার দেবভক্তির কথা সব আমি বলব কালুম-কালুমকে।
খুব খুশি হলো সর্দার। বলল, আমার গায়ের কথাও বোলো, বিটলাঙগোরগা। আমি কথা দিচ্ছি, যারা এখনও খারাপ আছে, তারা ভাল হয়ে যাবে। কালুম-কালুম যেন শাস্তি না দেন।
ওঝা বলল, বলব।
সর্দার আর ওঝার বদান্যতায় খুশি হলো জনতা। শতমুখে তারিফ করতে লাগল দু-জনের।
আরও বিমর্ষ মনে হলো তিন বন্দিকে। ভেতরে ভেতরে আসলে পুলকে ফেটে পড়ছে, কিন্তু সেটা প্রকাশ হতে দিল না।
উল্লাস ঢেকে রাখতে খুব কষ্ট হলো ছেলেদের।
আবার অপেক্ষার পালা। কবে আসে হেলিকপ্টার? জিভারোরা অপেক্ষায়। রয়েছে কবে নামবে দেবতার উড়ুকু-নৌকা?
অবশেষে এল সেই দিন।
ছেলেরা সবে নাস্তা শেষ করেছে, এই সময় শোনা গেল এঞ্জিনের শব্দ। কপ্টারের শব্দ তাদের কানে এত মধুর শোনায়নি আর কখনও। তাড়াহুড়ো করে, বাইরে বেরিয়ে এল ওরা।
একের পর এক নামতে লাগল হেলিকপ্টার।
জিভারোদের চোখে ভয় মেশানো কৌতূহল। এমন আজব নৌকা এই প্রথম। দেখছে। অতি দুঃসাহসী দু-একজন কাছে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু রোটর ব্লেডের জোরাল বাতাস গায়ে লাগতেই পিছিয়ে গেল, যতখানি না ধাক্কায়, তার চেয়ে অনেক বেশি, ভয়ে ভক্তিতে। এই বাতাস তাদের বিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দিল শতগুণ। ধরেই নিল, কালুম-কালুম অদৃশ্য ভাবে কাছেই রয়েছেন। তিনি বাতাসের দেবতা, শরীর অদৃশ্য রেখেছেন বটে, কিন্তু বাতাস সেটা প্রকাশ করে দিচ্ছেই। হেলিকপ্টারগুলোকে এক দফা প্রণাম করে নিল জিভারোরা।
এক সারিতে এগিয়ে গেল স্বর্গবাসীরা, তাদের পেছনে জিভারোদের দীর্ঘ মিছিল.। একে একে কপ্টারে উঠল ছেলেরা। আরেকটা কপ্টারে তোলা হলো তিন বন্দিকে। ওঠার সময় এমন ভান করল ওরা, যেন যেতে চায় না।
চাইবে কেন? ভাবল জিভারোরা। বলির শুয়োর হতে কে যেতে চায়?
বাকি রইল বিটলাঙগোরগা।
হামুকে কাছে আসার ইশারা করল সে।
এল সর্দার। চোখ ছলছল। ওঝাকে ভালবেসে ফেলেছিল।
মুখোশ খুলে বাড়িয়ে দিল ক্যাসাডো, নাও, এটা তোমাকে উপহার দিলাম। এটা দেখে আমাকে মনে কোরো।
চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারল না সর্দার। পাল বেয়ে গড়িয়ে নামল। ওঝার একটা হাত আলগোছে তুলে নিয়ে উল্টো পিঠে চুমু খেল। ধরা গলায় বলল, স্বর্গে গিয়ে আমাকে ভুলে যেও না, বিলাঙগোরগা।
কপ্টারে উঠল ক্যাসাডো।
এক এক করে আকাশে উঠতে লাগল কপ্টারগুলো।
বকের মত গলা লম্বা করে তাকিয়ে আছে জিভারোরা।
খোলা দরজা দিয়ে হাত বের করে নাড়ল কিশোর। ঠিকই চিনতে পারল পুমকা। জবাবে সে-ও নাড়ল। জিভারোরা বুঝল, এটা স্বর্গবাসীদের বিদায় সঙ্কেত। তারাও হাত নাড়তে শুরু করল।
খারাপ লাগল কিশোরের, সহজ-সরল মানুষগুলোকে এভাবে ধোঁকা দিয়ে। এসেছে বলে। কিন্তু এছাড়া আর করারই বা কি ছিল?