আমাদের নামিয়ে দিয়ে তো ফিরে আসতে পারবে?
মনে হয় না। আমাদের যেতেই অনেক সময় লাগবে। তার পর ফিরে আসতে আসতে বলি শেষ হয়ে যাবে। আরও একটা ব্যাপার আছে। ব্রাজিলিয়ান কর্তৃপক্ষ সহজে উপজাতীয়দের সঙ্গে বিরোধে যাবে না। এমনিতেই বশ্যতা মানতে চায় না ওরা, তার ওপর গোলাগুলি চললে আরও খেপে যাবে। ভাল মানুষ হলে কথা ছিল, তিনটে ক্রিমিন্যালের জন্যে কেন ওদের খেপাতে যাবে সরকার?
সবাই বিষণ্ণ। রাফিয়ানও বুঝতে পারছে, আনন্দের সময় নয় এটা। লেজ নিচু করে রেখেছে সে, কান ঝুলে পড়েছে। চুপচাপ বসে এর-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
কিন্তু এভাবে তিনটে মানুষকে জবাই করে ফেলবে, কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না জিনা, আর আমরা কিছুই করতে পারব না?
সে-রাতে কেউ ঠিক মত ঘুমাতে পারল না।
শুয়ে শুয়ে অনেক ভাল কিলোর। কি যেন একটা মনে আসি আসি করেও আসছে না, ধরতে পারছে না সে। ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল, ভেঙে গেল খানিক পরেই। লাফিয়ে উঠে বসল সে। বাইরে তখন ভোরের আলো। ডাকল। সবাইকে।
কি ব্যাপার, কিশোর? চোখ রগড়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
পথ পেয়ে গেছি।
কিসের পথ?
ওদের বাঁচানোর।
ঘুম দূর হয়ে গেল মুসার চোখ থেকে। অন্যেরাও সতর্ক। কিশোর কি বলে শোনার জন্যে অধীর।
কাজটা সহজ হবে না, কিশোর বলল। মিস্টার ক্যাসাডো, আপনার সহায়তা দরকার। ওরটেগাকেও খাটতে হবে।
ওরটেগা? ক্যাসাডো অবাক।
হ্যাঁ। সে ভেনট্রিলোকুইজম জানে।
তাতে কি? ক্যাসাডোর বিস্ময় বাড়ল। কিছুই বুঝতে পারছে না। খুলে বলো।
বুঝতে পারছেন না? ধরুন আরেকবার কথা ছুঁড়ে দিল ওরটেগা। কথাটা বেরোল চন্দ্রদেবীর মুখ দিয়ে…
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বসল ক্যাসাডো৷ ঠিক বলেছ! ঠিক! সহজেই বোঝাতে পারব হামুকে। দেবীকে অপমান করছে যারা তাদের বিচার দেবীই করুক, রায় দিক। তারপর তারপর আমি মূর্তিটাকে প্রশ্ন করব, সে জবাব দেবে.. চমৎকার! কিশোর, তুমি একটা জিনিয়াস।
এখনই এত শিওর হবেন না, মাথা নাড়ল কিশোর। জিভারোরা ইংরেজি জানে না। ওরটেগাও এদের ভাষা জানে না। কথা হবে কোন ভাষায়?
ওটা এমন কিছু কঠিন না, ক্যাসাডো বলল। জিভারো ভাষায় শব্দ খুবই কম, উচ্চারণও খুব সহজ, তা এতদিনে নিশ্চই বুঝেছ। তাছাড়া প্রশ্ন ঠিক করব আমি, জবাবও। সেই জবাবই মুখস্থ করাব তাকে।
খুশি হলো সবাই। যত শত্রুতাই করুক, তিনজন মানুষকে বলি দেয়া হবে– চোখের সামনে, এটা সহ্য করা যায় না।
সময় নষ্ট করল না ক্যাসাডো। তখুনি গেল হামুর কাছে।
সহজভাবেই মেনে নিল হামু। দেবতা কালুম-কালুম তার দেবীর অপমান হতো। দেখেছে, প্রতিশোধ তো নিতেই চাইবে। আর দেবীর বিচার দেবীই করুক, এটা চাওয়াটাও যুক্তিসঙ্গত। হামু.কেন মাঝখান থেকে উল্টোপাল্টা বিচার করে দেবতার কুনজরে পড়তে যাবে?
এক সঙ্গে দুটো কাজ করার হুকুম দিল সে তার লোকজনকে।
দেবতাদের উড়ুক্কু-নৌকা নামার জন্যে মঞ্চ বানানোর নির্দেশ দিল। আরেকটা উঁচু ছোট মঞ্চ বানাতে বলল তার কুড়ের সামনে, ওটাতে দেবীকে রাখা হবে। ওখান থেকেই বিচার করবে দেবী।
দেবীর মঞ্চ বানাতে বেশি সময় লাগল না।
খুব ধুমধাম করে নানারকম আচার-অনুষ্ঠান সেরে দেবীকে মঞ্চে তুলল ওঝা বিটলাঙগোরগা। গায়ের সবাই এসে ভক্তিভরে প্রণাম করে গেল দেবীকে।
এরপর অপেক্ষার পালা। কবে আসবে সেই শুভক্ষণ, যখন তিন বন্দির বিচার করবে দেবী। সময়টা ওঝা ঠিক করবে।
খুব বেশি সময় নেয়া যাবে না। ওরটেগাকে ভাষা শেখাতে শুরু করল, ক্যাসাডো। তবে জিভারোদের অলক্ষে। সে ওঝা। বন্দিদের কুঁড়েতে তার যাতায়াত কেউ সন্দেহের চোখে দেখল না।
অবশেষে এল সেই দিন।
সকাল থেকেই খুব উত্তেজনা। বিভিন্ন কারণে সবাই উত্তেজিত। গায়ের লোক, তিন গোয়েন্দা, জিনা, বন্দিরা, সবাই।
মঞ্চের সামনে এসে জড় হলো সব লোক। সকালের সোনালী রোদে ঝকঝক করে জ্বলছে চন্দ্রদেবী। নিজের কিরণ ছড়িয়ে দিয়ে স্ত্রীর ঝলমলে রূপকে শতগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে, যেন তার স্বামী সূর্যদেবতা। ভক্তিভরে বার বার প্রণাম করতে লাগল ইনডিয়ানরা।
মঞ্চে দেবীর পাশে গিয়ে দাঁড়াল ওঝা। যতরকম মালা আর সাজপোশাক। আছে, সব আজ গায়ে চাপিয়েছে। সব চেয়ে বিকট চেহারার মুখোশটা পরেছে। অপার্থিব লাগছে তাকে, ভয়ঙ্কর।
ঢিবঢিব করছে ছেলেদের বুক। হবে তো? কাজ হবে?
মঞ্চের পাশে বিশেষ আসনে বসেছে হামু, দু-পাশে আর সামনে বসেছে তার পরিবারের লোকজন। তাদের কাছেই সম্মানজনক দূরতে সম্মানিত আসনে বসেছে। তিন গোয়েন্দা আর জিনা। জিনার পাশে রাফিয়ান, গম্ভীর হয়ে আছে। বুঝতে পেরেছে, এটা ঘেউ ঘেউ কিংবা হালকা কিছু করার সময় নয়। ফিসফাস কানাঘুষা। করছে গায়ের লোকর স্বর্গের কুকুর তো, দেখো, কেমন ভাবভঙ্গি! দেবতার চেয়ে কম কি?
হাত তুলে ইশারা করল হামু।
পলকে থেমে গেল সমস্ত শব্দ।
আবার ইশারা করল সর্দার।
কয়েকজন যোদ্ধা গিয়ে বন্দিদের নিয়ে এল।
চ্যাকোর চেহারা ধসে গেছে। জিম আর ওরটেগা মোটামুটি ঠিকই আছে।
তিন বন্দিকে উদ্দেশ্য করে লম্বা বক্তৃতা দিল ওঝা। ওরটেগা কিছু কিছু বুঝল, অন্য দু-জন কিছুই বুঝল না। তবে ছেলেরা বুঝল বেশির ভাগই।
ঘন ঘন হাততালিতে ফেটে পড়ল জনতা। আরেকবার দেবীকে প্রণামের ধুম পড়ে গেল।
হাত তুলল বিটলাঙগোরগা।