তবে আপাতত বিপদ কেটে গেল।
পর্বতের তলায় একটা হ্রদ দেখা গেল দুপুর নাগাদ। রোদে ঝকমক করছে স্বচ্ছ পরিষ্কার পানি।
ছুটে গিয়ে জানোয়ারের মত উপুড় হয়ে পানিতে মুখ ডুবিয়ে দিল ইনডিয়ানরা। পেটভরে পানি খেয়ে, গায়ে মাথায় ছিটিয়ে উঠে এল।
ছেলেরা আর ক্যাসাডো খেল আঁজলা ভরে। খুব মিষ্টি। বোধহয় পর্বতের ওপরের বরফ গলা পানি ঝর্না বেয়ে এসে পড়ে এই হ্রদে।
হ্রদটা বেশি বড় না। বড় দিঘির সমান। কিশোরের মনে হলো, এটাই বোধহয়। সেই জলাশয়, যেটার কথা বলা হয়েছে ধাঁধায়।
ঠিক দুপুর। সূর্য মাথার ওপরে।
ব্যাপারটা আগে চোখে পড়ল মুসার, তার দৃষ্টিশক্তি খুব জোরাল। দেখো দেখো! একেবারে মাঝখানে দেখা যাচ্ছে সূর্যটা। অদ্ভুত, না?
অন্য ছেলেরাও দেখল।
বোধহয় উঁচু জায়গায় রয়েছি বলেই দেখতে পাচ্ছি, কিশোর বলল। ভৌগোলিক আরেকটা ধাঁধা। যাকগে, ওটা নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। পশ্চিমে দেখো এখন, চাঁদ দেখা যায় কিনা?
অনেকক্ষণ ধরে খুজল মুসা। মাথা নাড়ল, নাহ চাঁদ নেই।
পকেট থেকে কম্পাস বের করল কিশোর। পশ্চিম কোনদিকে, দেখল। তার কাছে ঘেঁষে এসেছে জিভারোরা। চোখে কৌতূহল নিয়ে দেখছে।
পশ্চিম ওদিকে, হ্রদের অন্য পাড়ের ঘন জঙ্গলের দিকে হাত তুলে দেখাল কিশোর। এই দিনের বেলায় চাঁদ ওঠার তো প্রশ্নই ওঠে না। যদি উঠতও, ওই জঙ্গলের জন্যে দেখা যেত না।
আমিও তাই ভাবছি, রবিন বলল।
দাঁড়াও দাঁড়াও, এক মিনিট! বলে উঠল জিনা। ওই যে দেখো, ওইই যে, ওদিকে।
ক্যাসাডোও দেখেছে ওটা। হাত তুলে দেখাল।
উল্লাসে চিৎকার করে উঠল জিভারোরা, ওরাও দেখেছে। ঘন জঙ্গলের দিকে এতক্ষণ চেয়ে ছিল বলে দেখতে পায়নি।
তিন গোয়েন্দা দেখল, পশ্চিমে এক জায়গায় প্রায় পানির ভেতর থেকে উঠে গেছে হালকা ঝোপঝাড়। তার মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে মিটার চারেক উঁচু বাসনের মত গোল একটা বস্তু। মুক্তোর মত দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সবুজ বনের মাঝে বিশাল এক মুক্তোর থালা যেন। দাঁড়িয়ে আছে লালচে পাথরের মঞ্চের ওপর।
গোল জিনিসটা কী, কি দিয়ে তৈরি, বুঝতে পারল না ছেলেরা।
ক্যাসাডোও পারল না।
তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর, ঘন ঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, বুঝেছি। সূর্যের আলো।
সূর্যের আলো? মুসা বুঝতে পারল না।
বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছোট ছোট, আয়না বসানো রয়েছে চাকাটায়। সূর্যরশ্মি পানিতে প্রতিফলিত হয়ে গিয়ে পড়ছে আয়নাগুলোতে। তাতেই সৃষ্টি হয়েছে ওই কৃত্রিম চাঁদ। আশ্চর্য! এত শত বছর আগেও জানত?
কারা জানত? কী?মুসার প্রশ্ন।
যারা ওই চক্র বানিয়েছে। সূর্যের আলোতে যে চাঁদ আলোকিত হয়, জানত একথা?
হয়তো জানত, রবিন বলল। হাজার হাজার বছর আগেই নাকি মানুষ। জ্যোতির্বিদ্যায় উঁচু পর্যায়ের জ্ঞান অর্জন করেছিল। মিশরের পিরামিড, ইনকা পিরামিড, স্টোনহেঞ্জ নাকি তারই স্বাক্ষর:..
বুদ্ধি ছিল মানতেই হবে, চক্রটার দিকে হাত তুলল মুসা। শুধু কাঁচ দিয়ে এত সুন্দর একটা জিনিস তৈরি করে ফেলল।
আমাদের দ্বিতীয় ধাঁধারও জবাব পেয়ে গেলাম।
হ্যাঁ, রবিনের সঙ্গে একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। এখন আইডল্টা খুঁজে বের করতে পারলেই…
কেল্লা ফতে! তুড়ি বাজাল মুসা।
দ্রুত জ্যোতি হারাচ্ছে কৃত্রিম চাঁদ। কারণ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে সূর্য, হেলে পড়ছে বলে বিশেষ অ্যাঙ্গেলটা আর থাকছে না। খানিক পরে কোন জ্যোতিই রইল না আর চক্রটায়, অতি সাধারণ একটা পাথরের বাসন।
জিভারোদের দিকে ফিরে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দিল ক্যাসাডো।
খুশিতে হুল্লোড় করে উঠল ইনডিয়ানরা।
ক্যাসাডোর ওপর শ্রদ্ধা, ভক্তিতে গদগদ। হবেই। মুখোশের ক্ষমতায় শত্রু তাড়াতে পারে যে ওঝা, পানির হ্রদ হাজির করে দিতে পারে, যে গুপ্তধন এত বছরেও কেউ পায়নি, সেটা পাওয়ারও ব্যবস্থা করতে পারে, তাকে ভক্তি না করে উপায় আছে।
ছেলেদের ওপরও ভক্তি বেড়েছে ওদের।
কাছে থেকে চাঁদটা দেখতে চলল কিশোর। সঙ্গে চলল মুসা, রবিন জিনা ও রাফিয়ান। পেছনে ক্যাসাডো, হামু আর তার দলবল।, তারও পরে রয়েছে হলুদ, দেবী, বিড়বিড় করল কিশোর। তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে সবুজ চোখে।
শুরুতে হালকা ঝোপঝাড়। কিন্তু খানিক পরে জঙ্গল এত ঘন হলো, পথ করে এগোনোর সাধ্য হলো না ছেলেদের। বাধ্য হয়ে পিছিয়ে এল। আগে বাড়ল কয়েকজন যোদ্ধা। পথ কেটে কেটে এগোল।
তিনশো মিটার মত এগিয়ে হঠাৎ থেমে গেল ওরা। ক্যাসাডো আর ছেলেরা বুঝতে পারল, অবশেষে দেখা পাওয়া গেছে চন্দ্রমন্দিরের।
সামনে অদ্ভুত একটা বিল্ডিং। সাদা রঙ করা। সামনের দিকটা বিচিত্র তৃতীয়ার চাঁদের আকার। চাঁদের ঠিক পেটের কাছে গোল বিরাট এক দরজা, ঢোকার জন্যে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে অভিযাত্রীদের।
মন্দির দর্শনেই কুঁকড়ে গেল জিভারোদের মন। ভক্তিভরে মাথা নুইয়ে প্রণাম করল ওরা, এগোতে সাহস করল না আর।
ছেলেদেরও বুক কাঁপছে। ঘন বনের ভেতরে ওই নির্জন এলাকায় এত পুরানো, একটা বাড়ি দেখলে অতি বড় সাহসীরও গা ছমছম করবে।
মাথা ঝাড়া দিয়ে অস্বস্তি তাড়াল যেন কিশোর। এসো, যাই। নিশ্চয় আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন সবুজ-চোখো চন্দ্রদেবী।
আরেকটু ভদ্রভাবে সম্মানের সঙ্গে বলো, নিচু স্বরে বলল মুসা, যেন দেবী সত্যিই শুনতে পাবে।