দ্বিধা করছে সাপটা। তারপর সিদ্ধান্ত নিল : এই জঘন্য জায়গা থেকে চলে যাওয়াই ভাল। খাওয়ার সময় এত গণ্ডগোল ভাল লাগে? যাই, অন্য কোথাও গিয়ে কিছু ধরে শান্তিতে খাই।
গাছের ডালে আর ফিরে গেল না সাপটা। পানিতে নেমেছে তো নেমেছেই। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিল। ধীরে ধীরে ভেসে চলল ভাটির দিকে।
জিনার ডাকে ফিরে আসছে রাফিয়ান, নিরাপদ দূরতে চলে এসেছে।
মোড়ের কাছে গিয়ে কোণাকুণি সাঁতরাতে শুরু করল সাপটা। চিত হারিয়ে। গেল ওপাশে।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল জিনা। মুসা, তোমার জন্যেই রাফিয়ান বাচল আজ!
০৯.
সবাই প্রশংসা করছে মুসাকে।
রবিন বলল, তোমার বই-পড়া কাজে লাগছে। মনে হচ্ছে শিকারী হিসেবে নাম কামাবে। জানোয়ারের ব্যবসার সব দায়দায়িত্ব শেষে না তোমার ঘাড়েই চাপে।
জবাবে হাসল মুসা। বলল, কতবড় দানব, দেখলে! এগুলোকেই ধরে ধরে খায় ইনডিয়ানরা। ওরা আরও বড় দানব।
হেসে উঠল ক্যাসাডো। স্বাদ কিন্তু ভালই। আমি খেয়ে দেখছি। ছোটগুলোর চেয়ে বড়গুলো অনেক বেশি টেস্ট। খাবে নাকি?
মুসা হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। বোঝা গেল খুব একটা অমত নেই। কিন্তু জিনা তাড়াতাড়ি দু-হাত নেড়ে বলল, না, বাবা, না, আমি নেই। সাপের গোস্ত! ওয়াক থুহ!
মুসা, তোমার ইচ্ছে আছে মনে হচ্ছে? রবিন জিজ্ঞেস করল।
জন্তু-জানোয়ার ধরতে গেলে কখন কি খেতে হবে কে জানে? মুসা বলল। সব সময় সঙ্গে খাবার না-ও থাকতে পারে। তখন তো জানটা বাঁচাতে হবে কোনমতে।
কিশোর বলল, হারাম…
আরে ধ্যাত্তোর, হারাম। জান বাঁচানো ফরজ।
এ-তো দেখছি জাত অ্যানিমেল ক্যাচার হয়ে যাচ্ছে। কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করল জিনা।
পাল্টা জবাব দিল মুসা, ফাঁকি দিলে কোন কাজেই উন্নতি হয় না।
হাসাহাসি করছে ছেলেরা, এই সময় হামুকে দেখা গেল। যোদ্ধাদের কারও কাছে কোন শিকার নেই। উদ্বিগ্ন, চোখেমুখে ভয়।
তাড়াহুড়ো করে মুখোশ পরে ফেলেছে ক্যাসাডো। সোজা তার কাছে এসে থামল হামু। প্রচুর হাত নেড়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে নিচু গলায় বলল কিছু। বেশির ভাগ শব্দই বুঝল না ছেলেরা।
ইংরেজিতে তাদেরকে জানাল ক্যাসাডো, হামু বলছে, শিকার মেলেনি। তার বদলে জঙ্গলের ভেতর দেখে এসেছে তাদের চিরশত্রু ট্র্যাকো ইনডিয়ানদের পায়ের ছাপ। ভয়াবহ যোদ্ধা ওরা। সুযোগ পেলেই অন্য গোত্রের ইনডিয়ানদের আক্রমণ। করে বসে। সব সময় একটা যুদ্ধংদেহী ভাব। কাজেই একেবারে চুপ, টু শব্দ করবে না। হামু বলছে, এখন থেকে নড়াও উচিত হবে না, তাহলে টের পেয়ে যাবে ট্রাকোরা। ওরা নাকি একটা জায়ারের পিছু নিয়েছে।
কিন্তু ট্রাকোরা যে টের পেয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, বুঝতে পারেনি হাম। জিভারোদের পায়ের ছাপ দেখে ফেলেছে একজন ট্রাকো যোদ্ধা। হামুর দলের পিছু নিয়ে চলে এসেছে। বনের ভেতর তাদের সতর্ক নড়াচড়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে রাফিয়ানের। চাপা গলায় গাউ করে উঠল।
চুপ। তার কানের কাছে ধমক দিল জিনা নিচু স্বরে। চুপ থাক!
ইশারায় কুলিদের চুপ থাকতে বলল হামু।
যোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি। উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে সবাই কুলিদের হাতেও লাঠি, বল্লম কিংবা তীর-ধনু।
চায় কি ব্যাটারা? কথা না বলে থাকতে পারল না মুসা।
ওরা হয়তো ভাবছে, হামু কোন বড় শিকার পেয়েছে, প্রায় শোনা যায় না, এমন ভাবে বলল ওঝা। ওটা ছিনিয়ে নিতে চায়। যখন দেখবে শিকার নেই, আমাদের সঙ্গে যা খাবার আছে লুট করে নিয়ে যাবে।
অবশ্যই যদি জিততে পারে, রহস্যময় শোনাল কিশোরের কণ্ঠ।
তাদের যথাসর্বস্ব লুট করে নিয়ে যাবে ট্রাকোরা, আর তারা এই গহন বনে না খেয়ে মরবে, এটা ভাবতেই ভাল লাগছে না কিশোরের। ফন্দি আঁটছে সে মনে। মনে। ফিফটি-ফিফটি চান্স যখন, ঝুঁকিটা নিতেই হবে।
জিনার মুখ সাদা হয়ে গেছে। পুমকার আতঙ্কিত চেহারা দেখেই আন্দাজ করতে পারছে ট্র্যাকোরা কতটা ভয়ঙ্কর। মূসার দিকে তাকাল রবিন। দুজনের। চোখেই ভয়। রক্ত সরে গেছে মুখ থেকে।
মিস্টার ক্যাসাডো, হাত বাড়াল কিশোর, আপনার মুখোশটা দিন। আ যোদ্ধাদের বলন, ওদের মাথা থেকে কিছু পালক খুলে দিতে। জলদি!
কেন চাইছে ওগুলো, বুঝতে পারল না ক্যাসাডো। কিন্তু বিনা প্রতিবাদে মুখোশটা খুলে দিল। যোদ্ধাদেরকে বলতেই ওরাও পালক খুলে দিল।
তাদের কাছ থেকে কয়েকটা বিচিত্র মালা নিয়ে রাফিয়ানের গলায় পেঁচিয়ে বাঁধল কিশোর। মাথায় আটকে দিল জিভারোদের মাথার একটা বন্ধনী, তাতে কয়েকটা পালক লাগানো। নিজে পড়ল মুখোশটা। মাথায় পালক গুজল।
অবাক হয়ে দেখছে সবাই। সর্দার হামুও এই বিচিত্র সাজ দেখে স্তম্ভিত। করছে। কি দেবতার ছেলে?
রাফিয়ানকে নিয়ে সামনে ছুটে গেল কিশোর, জঙ্গলের দিকে।
ঠিক ওই মুহূর্তে ঝোপ দু-হাতে ফাঁক করে বেরিয়ে এল দশ-বারোজন ট্র্যাকো, জিভারোদের আক্রমণ করার জন্যে। কিন্তু বেশিদূর এগোতে পারল না। কিশোর আর কুকুরটার দিকে চোখ পড়তেই পাথরের মত জমে গেল ট্র্যাকো-নেতা। লড়াইয়ের আগে চিৎকার করে যোদ্ধারা, একে বলে যুদ্ধ-চিৎকার। নেতাও ওরকম চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল, থেমে গেল মাঝপথেই। এমন অদ্ভুত দৃশ্য জীবনে, দেখেনি সে।
মুখোশটা ভীষণ ভারি, মাথা সোজা রাখতেই কষ্ট হচ্ছে কিশোরের, দম আটকে যাবে যেন। কিন্তু সে-সব পরোয়া না করে গলা ফাটিয়ে বিকট চিৎকার করে উঠল। সেই সঙ্গে হাত-পা নেড়ে নাচতে শুরু করল। নাচ মানে টারজান ছবিতে দেখা জংলী মানুষখেকোদের লাফঝাপের অবিকল নকল। মুখোশটা এক ধরনের অ্যামপ্লিফায়ারের কাজ করছে, ফলে কয়েক গুণ জোরাল শোনাল চিৎকার। সঙ্গে গলা মেলাল রাফিয়ান। তুমূল ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিল, সেই সঙ্গে তার বিশেষ নাচ–এক লাফে তিন হাত উঠে বাকা হয়ে আবার মাটিতে নামা। শুধু ইনডিয়ানরা কেন, এমন যুগল-নৃত্য জিনা, মুসা রবিন আর ক্যাসাডোও দেখেনি আর।