মাথা ঝাঁকাল ক্যাসাডো। যুক্তি আছে কথায়। কিন্তু আমার ধারণা, আরও বড় কোন পুকুর, কিংবা ছোটখাট হদের কথা বলা হয়েছে। যা দেখলাম ওগুলো সবই প্রায় ডোবা। যারা এই ধাঁধা বানিয়েছে, তারা যে বুদ্ধিমান ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। যখন দেখল, তাদের দিন শেষ হয়ে আসছে, গুপ্তধনগুলো লুকিয়ে ফেলল। সেই তারা বোধহয় চন্দ্রমন্দিরের ধর্মগুরুর দল। কেন লুকিয়েছে, তারাই জানে। তবে নিশ্চয় এমন কোথাও লুকায়নি, সহজেই যেখানকার চিহ্ন মুছে যাবে, অল্প কিছুদিন পরেই আর চেনা যাবে না। তারমানে, ধরে নেয়া যায়, এমন কোথাও লুকিয়েছে, অনেক বছর পরেও যে জায়গাটা নষ্ট হবে না।
সেটা হলেই ভাল, জিনা বলল।
আপনি ঠিকই বলেছেন, ক্যাসাডোকে বলল কিশোর। তা-ই করা হয়েছে।
পরদিন ইয়াপুরার একটা শাখা-নদীর তীরে পৌঁছল ওরা।
সরু নদী, খালই বলা চলে। এক ধারে জলা, অন্য ধারে ঘন জঙ্গল, কোথাও কোথাও অনেক সরে গেছে গাছপালা। ওসব জায়গায় বনের সীমানা আর পানির। সীমানার মাঝে শুকনো চরা, আঠাল মাটির নাম নিশানাও নেই। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল। একই জায়গায় শতরূপ।
গত কয়দিনে কাহিল হয়ে পড়েছে গোয়েন্দারা। সেটা দেখে হামুর সঙ্গে পরামর্শ করল ক্যাসাডো। সর্দার দেখল, শুধু দেবতার ছেলেরাই নয়, তার নিজের ছেলেও কাহিল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া খাবার ফুরিয়ে এসেছে, শিকার করা দরকার। ভেবেচিন্তে পুরো একটা দিন বালির চরায় বিশ্রামের কথা ঘোষণা করল হামু। ছেলেরা বিশ্রাম করবে, তাদের সঙ্গে থাকবে কুলিরা। যোদ্ধারা শিকারে যাবে।
দলবল নিয়ে শিকারে চলে গেল হামু।
আগুন জ্বেলে রান্নায় ব্যস্ত হলো কুলিদের কেউ, কেউ স্রেফ হাত-পা ছড়িয়ে বসে রইল।
জায়গাটা সুন্দর। ঝকঝকে সাদা বালি। নদীর পানিও টলটলে পরিষ্কার।
ক্যাসাডো আর মুখোশ রাখতে পারছে না মুখে। কত আর পারা যায়? গাঁয়ে থাকতে তো রাতের বেলা অন্তত খুলে রাখতে পারত। কিন্তু অভিযানে বেরোনোর পর সবার সঙ্গে একসাথে ঘুমাতে হয়, ফলে খুলতে পারে না।
কিন্তু এই গরমের মধ্যে নদীর পানির হাতছানি আর ঠেকাতে পারল না। কুলিদের কাছ থেকে সরে এল। এক জায়গায় পুমকা আর ছেলেরা বসে আছে। সেখানে এসে মুখোশ খুলে ফেলল সে।
ওঝার মুখ দেখতে পারায় নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করল পুমকা।
গোসল করবে নাকি? জিজ্ঞেস করল ক্যাসাডো।
ছেলেরাও সে-কথাই ভাবছিল; সে বলার পর আর দেরি করল না। জিনা ছাড়া বাকি সবাই টান দিয়ে দিয়ে কাপড় খুলে ফেলল। পুমকার কাপড়ই নেই, কোমরের আচ্ছাদন খোলার দরকার হয় না। কাপড়ের মত ভেজে না। পানি লাগলে ঝাড়া দিলেই পড়ে যায়।
নদীতে নামার আগে ভালমত দেখে নিল ওরা, নিশ্চিন্ত হয়ে নিল যে ওখানে অ্যালিগেটর নেই।
দাপাদাপি শুরু করল সবাই। ডুব দিচ্ছে, একে অন্যকে পানি ছিটাচ্ছে।
সব চেয়ে বেশি খুশি রাফিয়ান।
কুত্তাটা খুব ভাল, বলল পুমকা।
খুশি হলো জিনা। একটা ডাল ছুঁড়ে দিয়ে দেখো না, কেমন সঁতরে গিয়ে নিয়ে আসে। যত দূরেই ফেলো, নিয়ে আসবে।
নতুন ধরনের একটা খেলা পেয়ে গেল পুমকা। বার বার ডাল ছুঁড়ে ফেলে পানিতে, সাতরে গিয়ে নিয়ে আসে রাফিয়ান। নদীটা তেমন চওড়া নয়। জোরে একটা ভাল ছুঁড়ে মারল পুমকা। অন্য পাড়ের কাছে গিয়ে পড়ল ডালটা। চেঁচিয়ে বলল পুমকা, যাও তো দেখি, নিয়ে এসো। বাপের ব্যাটা বলব তাহলে।
এটা একটা কাজ হলো নাকি? এত সহজেই যদি বাপের ব্যাটা হওয়া যায়, ছাড়ে কে? রওনা হয়ে গেল রাফিয়ান। হাসিমুখে চেয়ে আছে সবাই।
অপর পাড়ে প্রায় পৌঁছে গেছে রাফিয়ান, হঠাৎ হাসি মুছে গেল পুমকার মুখ থেকে।
তার এই পরিবর্তন লক্ষ করল জিনা। পুমকার দৃষ্টি অনুসরণ করে চেয়ে তারও মুখের রঙ পাল্টে গেল। বড় বড় হয়ে গেল চোখ, তাতে আতঙ্ক।
মস্ত এক সাপ। একটা গাছের ডাল থেকে নেমে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে রাফিয়ানের দিকে। কুকুরটা টের পায়নি।
মুসাও দেখেছে সাপটা। অ্যানাকোণ্ডা! ফিসফিসিয়ে বলল সে। দুনিয়ার সব। চেয়ে বড় সাপ। এক নম্বর হারামী।
ক্যানোডি…ক্যানোডি! অ্যানাকোণ্ডার জিভারো নাম। দাঁতে দাঁতে বাড়ি লাগছে পুমকার, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।
ঘেউ ঘেউ শুরু করল রাফিয়ান, দেখে ফেলেছে সাপটাকে।
খালি সাপের বয়ান দিচ্ছ তোমরা, চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কিছু একটা করা দরকার।
পাঁচ-ছয় মিটার লম্বা হবে সাপটা। ভীষণ মোটা। জলপাই-সবুজের ওপর কালো ফুটকি।
জলদি! মুসা বলল। পুমকা, কুলিদের ওখান থেকে লাঠি নিয়ে এসো কয়েকটা। কুইক! বইয়ে পড়েছে কি করে বড় সাপ তাড়াতে হয়।
এক দৌড়ে গিয়ে কয়েকটা লাঠি নিয়ে এল পুমকা।
একটা লাঠি নিয়ে বলল মুসা, আমি যা করব, সবাই করবে। ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা করব।
লাঠি দিয়ে গায়ের জোরে পানি পেটাতে শুরু করল ছেলেরা, ক্যাসাডোও তাদের সঙ্গে যোগ দিল। সেই সঙ্গে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল সকলেই।
মুসা, অযথা চেঁচাচ্ছি, জোরে বলল রবিন। সাপের কান নেই, শব্দ শোনে।
তাই তো! ঠিক আছে, পেটানো থামিও না। কম্পন টের পাবে। ভড়কে যেতে পারে।
ঠিকই বলেছে মুসা।
সাপটা বোধহয় ভাবল : আহ, এ-কি জালাতন! কি কাঁপাটা- না কাঁপছে। পানি। ঝড় উঠল নাকিরে বাবা? শুরু করেছে কি দু-পেয়ে জীবগুলো? যে চারপেয়েটাকে ধরতে যাচ্ছি, সেটাকেও তো চিনতে পারছি না। বানর কিংবা শুয়োরের মত মোটেও নয়। খেতে কেমন লাগবে কে জানে?