আবার ছাড়ল বিমান। নিচে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল আলোকিত রাতের শহর। মাঝে আর কোন স্টপেজ ধরবে না, একেবারে রিও ডি জেনিরোতে গিয়ে নামবে প্লেন।
কমে এল কেবিনের শোরগোল, খানিক পরে থেমে গেল পুরোপুরি। হালকা মিউজিক আর নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে জিনা এখনও।
মুসা সীটে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে, রবিন তুলছে।
কিশোরের ঘুম আসছে না। একটা ম্যাগাজিন টেনে নিল। মন বসাতে পারল। রেখে দিয়ে শেষে লোকগুলোর দিকে তাকাল। চারজন কেয়ার টেকার এক জায়গায় বসেছে।
চ্যাকো ব্যাটার চেহারা মোটেও ভাল না, ভাবছে কিশোর। মস্ত এক ষাড় যেন, গুতো মারার জন্যে তৈরি হয়ে আছে। চারকোণা চোয়াল, আর কি বিচ্ছিরি চওড়া কপাল। ব্যাটার গায়ে মোষের জোর, সন্দেহ নেই, তবে মাথায় ঘিলু কম। বাচ্চাদের পাহারা দেয়ার জন্যে এমন একটা বাজে লোককে কি করে বাছাই করল এজেন্সি?
দ্বিতীয় লোকটার নাম জিম। বয়েস বাইশের বেশি না। মোটামুটি সিরিয়াস। লোক বলে মনে হলো কিশোরের। কারলোর মত ষাঁড় নয়, সুদর্শন। ধোপদুরস্ত পোশাক।
তৃতীয়জন ওরটেগা। বেঁটে, রোগা, চামড়ার রঙ গাঢ় বাদামী। ইংরেজিই বলছে, তবে তাতে কড়া বিদেশী টান, কথা বলার সময় খালি হাত নাড়ে।
পর্তুগীজ নাকি? ভাবছে কিশোর। ব্রাজিলের ভাষা পর্তুগীজ। লোকটার কথায়ও পর্তুগীজ টান, ভাষাটা জানে বলেই বোধহয় তাকে বাছাই করা হয়েছে।
চতুর্থ লোকটার নাম হেনরিক। কিশোরের মনে হলো, ওই একটিমাত্র লোক সত্যিকারের কেয়ার টেকার, বাচ্চাদের কিভাবে সামলাতে হয় জানে। সারাটা দিন ওদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে, ক্লান্ত হয়ে ঢুলছে এখন ওদের সঙ্গে সঙ্গে।
অন্য তিনজনের দিকে চোখ ফেরাল আবার কিশোর। তাদের চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। এত উত্তেজিত কেন ওরা? ভাবল সে। কোন কিছুর অপেক্ষায় আছে?
হাই তুলতে শুরু করল কিশোর।
হঠাৎ তন্দ্রা টুটে গেল তার। লাউডস্পীকারে বেজে উঠেছে ক্যাপ্টেনের গমগমে কণ্ঠ। গুড মর্নিং, লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই রিও ডি জেনিরোতে নামছি আমরা। দয়া করে।
কথা শেষ হলো না, থেমে গেল আচমকা, বিচিত্র কিছু ফিসফাস আর খুটখাট শোনা গেল স্পীকারে।
অবাক হলো কিশোর। কিসের শব্দ? যন্ত্রটন্ত্র খারাপ হয়ে গেল, নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ক্যাপ্টেন?
দেখল, চ্যাকো আর জিম নেই, ওরটেগা দাঁড়িয়ে আছে ককপিটের দরজার কাছে। পাহারা দিচ্ছে যেন। দৃষ্টি চঞ্চল, একবার কেবিনের দিকে তাকাচ্ছে, একবার দরজার দিকে।
তাজ্জব ব্যাপার তো! এমন করছে কেন?
একজন স্টুয়ার্ডেসের সঙ্গে কথা বলছে হেনরিক। দুজনকেই চিন্তিত মনে। হচ্ছে। সারাক্ষণ লেগে থাকা হাসি উধাও. স্টুয়ার্ডেসের মুখ থেকে। বার বার তাকাচ্ছে স্পীকারের দিকে, হঠাৎ থেমে যাওয়ার কারণ আন্দাজ করতে চাইছে।
শেষে আর থাকতে না পেরে বলল, যাই, দেখে আসি কি হলো?
কিন্তু তাকে ককপিটে ঢুকতে দিল না ওরটেগা।
যাওয়া যাবে না, এত জোরে বলল, কেবিনের সবাই শুনতে পেল। সীটে। গিয়ে বসুন।
বোকা বনে গেল স্টুয়ার্ডেস। ঢোক গিলে বলল, কাকে কি বলছেন? যাওয়া যাবে না মানে? যান, সীটে গিয়ে বসুন। এখানে আসার অনুমতি নেই আপনার, বেআইনী কাজ করছেন।
বিদ্রুপের হাসি ফুটল ওরটেগার ঠোঁটে। কেন বাজে বকছেন? যান, গিয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মত চুপ করে বসুন।
মৃদু গুঞ্জন যেন ঢেউয়ের মত বয়ে গেল যাত্রীদের মাঝে।
ওরটেগার হাতে বেরিয়ে এসেছে একটা পিস্তল।
স্টুয়ার্ডেসের দিকে ফেরাল সে নলের মুখ।
.
০২.
কি করছেন আপনি, জানেন? জোর নেই স্টুয়ার্ডেসের কণ্ঠে।
জবাব দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না ওরটেগা।
ককপিটের দরজায় দেখা দিল চ্যাকো, তার হাতেও পিস্তল।
আর কোন সন্দেহ রইল না কিশোরের। ফিসফিস করে বন্ধুদের বলল, হাইজ্যাকার!
গুঞ্জন বাড়ল। চেঁচিয়ে উঠল একজন। কি হচ্ছে, জানতে চায়। তার সঙ্গে গলা মেলাল আরও কয়েকজন।
লাফিয়ে উঠল হেনরিক। কি করছ? ভয় দেখাচ্ছ কেন ছেলেমেয়েদের। এসব রসিকতার কোন মানে হয়?
এগিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে আবার তাকে বসিয়ে দিল চ্যাকো। না, হয় না। কিন্তু রসিকতা করছি না, এটা আসল। বসে থাকো চুপচাপ।
তর্ক করে লাভ হবে না, বুঝল হেনরিক, আর কথা বাড়াল না।
আতঙ্কিত ছেলেমেয়েদের দিকে ফিরল চ্যাকো। শোনা খোকাখুকুরা, কর্কশ। কণ্ঠ মোলায়েমের ব্যর্থ চেষ্টা করল, অনুমান করতে পারছ কিছু?
হাইজ্যাক! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। প্লেন হাইজ্যাক করেছ।
মুসার বলার ধরন পছন্দ হলো না চ্যাকোর, হাসল বটে, কিন্তু চোখ দুটো শীতল। ঠিক ধরেছ। এখন ভাল-মন্দ তোমাদের ওপর। আমাদের কথা শুনলে কারও কোন ক্ষতি হবে না। যেখানে আছ, থাকো, যা করছিলে করো। গল্প করো, পড়ো, কিংবা মিউজিক শোনো।
কেবিনে বেরিয়ে এল জিম।
তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল চ্যাকো, ওদিকে সব ঠিক আছে?
আছে। ক্যাপ্টেন, কো-পাইলট, রেডিওম্যান, কেউ গোলমাল করবে না।
কি করেছ ওদের? আবার সীট থেকে উঠতে শুরু করল হেনরিক।
বসো, পিস্তল নাচাল চ্যাকো।
মারিনি, বেধে রেখেছি। যাতে নড়তে না পারে, জিম বলল।
তাহলে কি..
হ্যাঁ, অটোমেটিক পাইলটে চলছে প্লেন। এখানকার অবস্থা দেখতে এসেছি। সবাইকে শান্ত করে গিয়ে কন্ট্রোল হাতে নেব। আমিই চালাব প্লেন। চ্যাকো,