কত বড় হয়? জানতে চাইল জিনা।
পূর্ণবয়স্ক জাগুয়ার দেড়শো কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়, গড়গড় করে মুখস্থবিদ্যা, ঝাড়ল মুসা। প্রচণ্ড শক্তি গতি আর ক্ষিপ্রতা চমকে দেয়ার মত। আর রঙ..রঙ … চিতার মত। চিতা বাঘের মত ফুটকি…।
ভয়ঙ্কর শব্দ হলো। তুলনা করা কঠিন। নাম শুনে বিশেষ প্রতিক্রিয়া হয়নি। ছেলেদের, কিন্তু ডাক শুনে ভয়ে কেঁপে উঠল বুক। ডাকই যার এমন, কতখানি ভয়ানক জানোয়ার সে!
ইশারায় সবাইকে চুপ থাকতে বলে হাতের রাইফেলটা শক্ত করে চেপে ধরল হামু। পা টিপে টিপে এগোল চিৎকারটা যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে। হারিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে।
ভেবে অবাক হয় ক্যাসাডো, রাইফেল আর গুলি কোথা থেকে সংগ্রহ করে হামু? অনেক চেষ্টা করেছে বৈমানিক, রহস্যটা রহস্যই থেকে গেছে তার কাছে। জানতে পারেনি। ২ পাথর হয়ে গেছে যেন সবাই। চোখের পাতা নাড়তে ভয় পাচ্ছে। এক চিৎকারেই কাপুনি তুলে দিয়েছে জাগুয়ার।
গোঁ গোঁ করেই চলেছে রাফিয়ান, ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। শক্ত করে তার কলার চেপে ধরে রেখেছে জিনা। কোনভাবেই গোঙানি থামাতে না পেরে শেষে মুখ চেপে ধরল।
একটি মাত্র গুলির শব্দের পর অখণ্ড নীরবতা।
হাসিমুখে জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল হামু।
এই হাসির অর্থ জানা আছে জিভারোদের। শোরগোল তুলে ছুটে গিয়ে ঢুকল বনের ভেতরে। বেরিয়ে এল খানিক পরেই। টানতে টানতে নিয়ে এসেছে শিকার।
জানোয়ারটা আসলেই বড়!
অনেকক্ষণ ধরে নানাভাবে সর্দারের প্রশংসা করল যোদ্ধারা। তারপর জাগুয়ারের ছাল ছাড়িয়ে মাংস কেটে ভাগাভাগি করে কাঁধে তুলে নিল।
আবার শুরু হলো চলা। জাগুয়ারের ডাক আর চেহারা দেখে ভয় পেয়েছে ছেলেরা, চুপসে গেছে ফাটা বেলুনের মত। শুরুতে যে হাসি হাসি ভাবটা ছিল, এখন আর নেই।
দুই দিন পর শুরু হলো জলাভূমি।
গত দু-দিনের যাত্রাটা সুখকর হয়নি মোটেও। আঠাল, গরম, ভেজা পথ, মশা, তাড়ানোর জন্যে রাতে ক্যাম্পের আগুনের ধোয়া, সারাক্ষণ হিংস্র জানোয়ারের আনাগোনা, ভাল লাগার কথাও নয়। জাগুয়ারটা মারার পর থেকে হাটার সময়ও স্বস্তি পায়নি ছেলেরা। মনে হয়েছে, এই বুঝি অন্ধকার কোন ঝোপ থেকে লাফিয়ে। এসে ঘাড়ে পড়ল আরেকটা জাগুয়ার।
ব্রাজিলের জঙ্গলের জলা কেমন, অস্পষ্ট ধারণা আছে বটে ছেলেদের, কিন্তু এতখানি খারাপ, কল্পনাও করেনি। এখনও ভালমত শুরু হয়নি জলাভূমি, তাতেই এই অবস্থা, আসল জায়গায় গেলে কেমন হবে ভেবে ভয় পেল ওরা।
বড় বড় গাছ ডালপাতা ছড়িয়ে রেখেছে, প্রায় প্রতিটি গাছের নিচ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে অসংখ্য নালা, নালার জল বলা চলে। বনতলে আবছা অন্ধকার, বাষ্প। উঠছে। এত আঠা করে দেয় শরীর, গায়ে জামাকাপড় রাখাই দায় কেন শুধু পাতার আচ্ছাদন কোমরে জড়ায় এখানকার ইনডিয়ানরা, বোঝা গেল। য়েখানে। পানি নেই, সেখানটাও শুকনো নয়, প্যাঁচপেচে কাদা। পচা পাতার গন্ধে বাতাস ভারি। ওসব পাতার ভেতরে ভেতরে কিলবিল করছে জোক আর নানারকম পোকামাকড়, কোন কোনটা সাংঘাতিক বিষাক্ত।
আস্ত নরক? নাক কুঁচকাল জিনা। এসব জায়গায় মানুষ আসে নাকি!
তাহলে আমরা এলাম কেন? ভুরু নাচাল মুসা, আমরা কি মানুষ নই?
আমরা কি আর ইচ্ছে করে এসেছি? ঠেকায় পড়ে।
জবাব নেই মুসার। চুপ হয়ে গেল।
চওড়া একটা খালের ভেজা তীর ধরে এগিয়ে চলল ওরা।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে লাফিয়ে সরে এল রবিন। ঝপাং করে গিয়ে পানিতে পড়ল। একটা জীব। গাছের গুঁড়ি মনে করে ওটার ওপর পা দিয়ে ফেলেছিল সে।
অ্যালিগেটর। আবার বিদ্যা ঝাড়তে শুরু করল মুসা। খুব পাজি জীব। দেখেশুনে পা ফেলবে।
কিন্তু খানিক পরেই মুসা নিজে যখন একটা অ্যালিগেটরের ওপর পা ফেলল, আর ঝাড়া দিয়ে তাকে উল্টে ফেলে পালাল ওটা, হাত ধরে টেনে তুলে গম্ভীর মুখে বলল রবিন, অ্যালিগেটর যে কুমিরের এক প্রজাতি, তা কি জানো? বড়গুলো মানুষখেকোও হয়। ঠিকই বলেছ, খুব পাজি জীব। সুতরাং, সাবধান, কানার মত পা ফেলো না। শেষে অ্যালিগেটরের নাস্তা হয়ে যাবে।
হেসে উঠল জিনা আর কিশোর, খুব একহাত নিয়েছে রবিন।
ক্যাসাডোও হাসি চাপতে পারল না।
ইনডিয়ানরা তো দাঁত বের করে হাসছে মুসার অবস্থা দেখে।
বেশ অনেকখানি পথ পেরোল সেদিন দলটা। খালের পাড়ের কুচকুচে কালো মাটি নরম, স্পঞ্জের মত, পা পড়লে দেবে যায়। তোলার সময় আবার কামড়ে ধরে রাখে। কলা পাতা কেটে আনল ইনডিয়ানরা। সেগুলো দিয়ে পা মুড়ে লতা দিয়ে বাধল। এই আদিম জুতো বেশ কাজের। কাদা লাগে না, মাটির কামড় বসে না। তাছাড়া পোকামাকড়ের কামড়ও ঠেকায়।
রবিনের আহত গোড়ালি আবার ব্যথা শুরু করেছে। জ্বর জ্বর লাগছে তার।
পুকুরটা কোথায় পাওয়া যাবে? বিকেলের দিকে বলল সে। আর তো পারি। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার অবস্থা।
ডজন ডজন পুকুর আর ডোবা তো পেরিয়ে এলাম, বলল জিনা।
হ্যাঁ, কিশোর চিন্তিত। ওগুলোর কোনটাই নয়। এত কালো আর ঘোলা ওগুলোর পানি, চারপাশে জঙ্গল ঘিরে রেখেছে, ওগুলোতে রোদই পড়ে না। ঠিকমত। মাঝপরে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখা যাবে কি করে? তাছাড়া ওগুলোর ধারেকাছে কোন পাহাড় নেই।
তবে, রবিন বলল, মনে হয়, পেয়ে যাবই। কিশোর, আরেকটা কথা ভেবেছ? ধাঁধা অনেক পুরানো। যখনকার কথা, তখন হয়তো পুকুরপাড়ে গাছ ছিল। না। কিন্তু এতদিনে কি জন্মায়নি? কে সাফসুতরো করে রাখতে গেছে?