চুপ হয়ে গেল মুসা।
কিশোর, কি হবে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
বুঝতে পারছি না। এখানে বসে মাথা ঘামিয়ে লাভ হবে না। পুকুরটা খুঁজে বের করার পর হয়তো কিছু বোঝা যাবে।
ওটা কোথায় আছে, কি করে জানছ?
ক্যাসাডো বলল না, এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে একটা জলা জায়গা আছে। পুকুরটা সম্ভবত ওখানে। চারপাশে জঙ্গল ঘিরে রাখলে রোদই পড়বে না ঠিকমত, থাকত সূর্যের প্রতিবিম্ব।
কিন্তু ওখানে যাওয়া খুব কঠিন, ক্যাসাডো একথাও বলেছে, মনে করিয়ে দিল। মুসা। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে হবে, নানারকম হিংস্র জানোয়ার আছে, বিষাক্ত পোকামাকড় আছে। যেতে অনেক সময়ও লাগবে।
লাগুক না, কিশোর বলল। সময়ের তোয়াক্কা কে করছে? সময়টা আমাদের। জন্যে কোন সমস্যা না, যত খুশি লাগুক। হ্যাঁ, এবার তৃতীয় ধাঁধাটা কি বলে দেখি।
নোটবুকটা নিয়ে পাতা ওল্টাচ্ছে পুমকা। সাদা কাগজে বিজিবিজি কালো অক্ষরগুলো খুদে গোবরে পোকার মত লাগছে তার কাছে, ব্যাপারটা ভারি মজার আর রহস্যময় মনে হচ্ছে।
তার হাত থেকে নোট বই নিয়ে ধাঁধাটা বের করে পড়ল কিশোর, তারও পরে রয়েছে হলুদ দেবী, তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে সবুজ চোখে।
এটা সহজ, জিনা বলল।
তাই মনে হচ্ছে? মুসার কাছে সহজ লাগছে না।
তাই তো।
কি?
গুপ্তধন। হলুদ দেবী মানে হলুদ কোন মূর্তিতি হবে, আইডল।
হ্যাঁ হ্যাঁ, জিনার কথায় সায় দিল রবিন। হলুদ বলেছে তো, তার মানে। সোনার মূর্তি।
আর সবুজ চোখ কোন মূল্যবান পাথর? মুসার প্রশ্ন।
সম্ভবত পান্না, কিশোর জবাব দিল। ব্রাজিলে এক সময় খনি থেকে দারুণ। দারুণ পান্না তোলা হত। হয়তো প্রাচীন সেই সভ্যতার যুগে—
আর কিছু শোনার দরকার মনে করল না মুসা। হুররে! বলে চেঁচিয়ে উঠে নাচতে শুরু করল। হয়ে গেছে কাজ। সমাধান করে ফেলেছি আমরা।
কিছুই বুঝল না পুমকা, কিন্তু মুসার আনন্দ সংক্রামিত হলো তার মাঝে। সে ও, লাফাতে শুরু করল। যোগ দিল রাফিয়ান। জিনা আর বসে থাকে কি করে? রবিনই বা কেন বসে থাকবে? বসে রইল শুধু কিশোর। সে বুঝতে পারছে, আসলে কোন সমাধান হয়নি। এত সহজ নয় ব্যাপারটা। কিন্তু সেটা বলে বন্ধুদের আনন্দে বাধা দিতে চাইল না।
কুঁড়ের দরজায় বসে ছেলেদের আনন্দ দেখে ক্যাসাডোর মুখও উজ্জ্বল হলো। সে ধরেই নিল, ধাঁধার সমাধান হয়ে গেছে। উঠল। পায়ে পায়ে এগোল সে, জানার জন্যে।
.
উত্তেজনা চরমে পৌঁছল। হামু দলবল নিয়ে তৈরি।
ওঝা বিটলাঙগোরার নির্দেশ মত ওভদিন ওভক্ষণ দেখে বেরিয়ে পড়ল দলটা।
জিভারো গায়ের মাহল কয়েক পর থেকেই শুরু হলো ঘন জঙ্গল। লতা এমন ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে হাটাই মুশকিল।
শুরুতে যা ছিল, তার চেয়ে গতি অনেক কমে গেল।
আগে আগে চলেছে কয়েকজন জিভারো যোদ্ধা, ওরা পথ-প্রদর্শক। তাদের পেছনে সর্দার হাম আর তার ছেলে, ঠিক পেছনেই ওঝা। তার পরে মালপত্র বাহকদের সঙ্গে ছেলেরা। রাফিয়ান তাদের পাশেই চলছে।
ওরা যেদিন রওনা হয়েছে, তার আগের দিন প্লেনে গিয়ে শেষবারের মত এস ও এস পাঠিয়েছে ক্যাসাডো, কিন্তু দুর্ভাগ্য, কোন জবাব মেলেনি।
হলো না। ফিরে এসে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলেছে বৈমানিক। যাকগে, যা হওয়ার হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না আমাদের। ফিরে এসে আবার যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাব। অবশ্য যদি ফিরতে পারি। যা ভয়ানক জঙ্গল।
সামনে যারা চলেছে, তাদের হাতে ভোজালির মত বড় ছুরি।, ওগুলো দিয়ে ঘন, ঝোপ আর লতা কেটে পথ করে নিচ্ছে। খুব কষ্টকর আর ধীর কাজ।
অসহ্য ভ্যাপসা গরমে ঘামছে ছেলেরা। আঠা আঠা হয়ে যাচ্ছে.সে ঘাম, ভীষণ অস্বস্তি হয়।
রাফিয়ানেরও জিভ বেরিয়ে পড়েছে, হাপাচ্ছে। এই গরম সে-ও সইতে পারছে
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সে কুজো করে ফেলেছে পিঠ। ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে। জঙ্গলের দিকে চেয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে, চাপা ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে গলার গভীর থেকে।
কুকুরটার মতই দাঁড়িয়ে গেছে জিভাবোরা। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফিয়ানের মতই বিপদের গন্ধ পেয়েছে ওরাও।
জাগুয়ার! ফিসফিস করে বলল ক্যাসাডো।
ব্রাজিলের জঙ্গলের ভয়ঙ্করতম জানোয়ার জাগুয়ার, বলল মুসা। ইদানীং জন্তু জানোয়ার সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছে সে। কারণও আছে। তার বাবা মিস্টার রাফাত আমানের মাথায় ঢুকেছে, জানোয়ারের ব্যবসা সাংঘাতিক লাভজনক। দেশবিদেশ থেকে দুর্লভ জানোয়ার ধরে এনে বিভিন্ন চিড়িয়াখানা, সার্কাস পাটি আর জন্তু জানোয়ার পোষার সংগঠনগুলোতে বিক্রি করা যায়, যথেষ্ট চাহিদা। লস অ্যাঞ্জেলেসে মাত্র একজন ব্যবসায়ী আছে, তা-ও খুব ভাল ব্যবসায়ী নয়, চাহিদামত সরবরাহ করতে পারে না। ব্যবসাটা খুব মনে ধরেছে মূসার বাবার। সেটা আবার কথায় কথায় জানিয়েছেন কিশোরের চাচা রাশেদ পাশাকে। ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবসার। দিকে এমনিতেই ঝোঁক রাশেদ চাচার, মুসার বাবার কথায় লাফিয়ে উঠেছেন, পার্টনারশিপে ব্যবসা করবেন দু-জনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। স্যালভিজ ইয়ার্ডের দুই কর্মচারী বোরিস আর রোভারের সাহায্যে অনেকখানি জায়গার জঞ্জাল পরিষ্কার। করে সেখানে জানোয়ার রাখার খাঁচাও বসাতে শুরু করেছেন। পড়াশোনা শুরু করেছেন মিস্টার আমান, তার দেখাদেখি মুসাও। জন্তু-জানোয়ার সম্পর্কে যত বই পাচ্ছেন সর্ব কিনে এনে পড়ে ফেলছেন। কিভাবে ধরতে হবে, সেটা জানার জন্যে, প্র্যাকটিকাল ট্রেনিং নিচ্ছেন মাস্টার রেখে। ইতিমধ্যেই অনেক কিছু শিখে ফেলেছে মুসা। এই জন্তু জানোয়ার ধরে এনে বিক্রি করার ব্যবসা কতখানি। লাভজনক হবে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই কিশোর বা মুসার, কিন্তু। সাংঘাতিক সব অভিযানে বেরোতে পারবে বুঝতে পেরে ভীষণ আগ্রহী হয়েছে ওরাও রাশেদ চাচার সংগ্রহ করা বইগুলো প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছে কিশোর।