যদি গুপ্তধন পাওয়া যায়, দেবে মুক্তি পথ দেখিয়ে উপত্যকায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে লোক দেবে। এত উত্তেজিত হয়েছে, মোটেই দেরি করতে চায় না, পারলে এখুনি রওনা হয়। পাওয়া গেলে কথা রাখবে হামু, জঙ্গল পেরোতে সাধ্যমত সাহায্য করবে তোমাদের। তখন কোন একটা ছুতোয় আমিও সঙ্গে যাব তোমাদের।
খুব ঠাণ্ডা স্বভাবের লোক হামু। কোন ব্যাপারে হুট করে উত্তেজিত হয় না। ভেবে-চিন্তে কাজ করে। কিন্তু কোন ব্যাপারে যদি একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, সেকাজ থেকে আর ফেরানো যায় না তাকে, শেষ না দেখে ছাড়ে না।
বিটলাঙগোরগা বলেছে, ছেলেরা এসেছে গুপ্তধন খুঁজে বের করে জিভারোদের চিরসৌভাগ্য বহাল করার জন্যে, এর চেয়ে খুশির খবর আর কি হতে পারে হামুর জন্যে?
এতবড় দায়িত্ব, যাকে তাকে সঙ্গে নেয়া যায় না। বেছে বেছে লোক ঠিক করল হামু। সবাই ভাল যোদ্ধা, তার খুব বিশ্বস্ত। পুমকাকেও নেবে সঙ্গে।
আনন্দে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে লাগল পুমকা। গায়ের ছেলেরা তার সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত। সেদিন থেকে অভিযাত্রীদের কাছছাড়া হয় না সে পারতপক্ষে, ওরা যেখানে যায়, সে-ও সঙ্গে সঙ্গে যায়।
এক্কেবারে আরেক রাফিয়ান, জিনা মন্তব্য করল।
কিন্তু এসব হালকা রসিকতায় কান দেয়ার মানসিকতা নেই কিশোরের। রবিন। আর মুসাও বুঝতে পারছে, কতখানি জটিল হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি।
গুপ্তধন পাওয়া গেলে তো খুবই ভাল, বাঁচলাম, কিশোর বলল, কিন্তু যদি না পাই, কি হবে ভেবে দেখেছ? ক্যাসাডোর কি অবস্থা হবে? হামু ধরে নেবে, তার সঙ্গে মিথ্যাচার করা হয়েছে, তাকে ফাঁকি দেয়া হয়েছে, ঠকানো হয়েছে। ঠাণ্ডা মানুষ রাগলে ভয়ানক হয়ে যায়। দেবতার কাছ থেকে এসেছি আমরা, সে-বিশ্বাস হারাবে হামু। ধরে সোজা বলি দিয়ে ফেলবে তখন।
তাই তো, এটা তো ভাবিনি! নিমেষে হাসি হাসি মুখটা কালো হয়ে গেল জিনার।
যা হবার হবে, মুসা বলল। আমার বিশ্বাস, তুমি ওগুলো খুঁজে পাবেই।
বেশি ভরসা করছ মুসা, কিশোর বলল। যদি সত্যি থাকে, হয়তো পাব। কিন্তু যদি না থাকে?
.
০৮.
ধাঁধার তিনটে অংশ, সাবধানে নোট করে নিল কিশোর। ক্যাসাডোর মুখে শুনেই মুখস্থ করে ফেলেছে, তবু লিখে নিল। অনেক সময়, লেখার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক জটিল রহস্যের গিট খুলে যায়, কিশোরের বেলায়ই কয়েকবার ঘটেছে এই ঘটনা।
বন্ধুদেরকে নিয়ে গায়ের ধারে বিশাল এক গাছের ছায়ায় এসে বসল সে। ধাঁধা। সমাধানের চেষ্টা করবে। খানিক দূরে বসে উৎসুক হয়ে তাদের দিকে চেয়ে রইল। রাফিয়ান আর পুমকা।
দূরে কুঁড়ের দরজায় বসে এদিকেই ফিরে রয়েছে ক্যাসাডো। সে কি ভাবছে, জানে না, ছেলেরা। সে ভাবছে, কাজটা খুব খারাপ হয়ে গেল। নিজের ওপরই রেগে গেছে। যাওয়ার সব যোগাড় করে ফেলেছে হামু, এখন তাকে আর কিছুতেই ফেরানো যাবে না, কিছু বলেই বোঝানো যাবে না। যেতে না চাইলে খারাপ অর্থ করবে। ভাল বিপদেই পড়া গেছে। কেন যে বাচ্চাদের কথায় নাচলাম! ধাঁধা। সমাধানের চেষ্টা তো আমিও অনেক করেছি। পেরেছি? কয়েকটা ছেলে পারবে, কেন বিশ্বাস করতে গেলাম?
ঘাসের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে কিশোর। সামনে খোলা নোটবুক। পুকুরের ঠিক মাঝখানে পড়বে সূর্য, বিড়বিড় করল সে। তারপর পশ্চিমে দেখতে পাবে অস্তপ্রায় চন্দ্র। তারও পরে রয়েছে হলুদ দেবা, তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে সবুজ চোখে। মানে কি?
কেউ জবাব দিল না।
তিনটে ধাঁধা, আবার বলল সে, একটার সঙ্গে আরেকটা কোনভাবে গাথা।
হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে, রবিন বলল। দ্বিতীয় ধাঁধাটা শুরু হয়েছে তারপর দিয়ে। তৃতীয়টা শুরু হয়েছে তারও পরে দিয়ে। সিরিয়াল ঠিকই আছে।
হুঁম! মাথা দোলাল জিনা।
মুসা কিছুই বলল না। মাথাখাটানো নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই তার, ধাঁধা– আর বুদ্ধির কচকচি ভালও লাগে না।
পুকুর তো বুঝলাম, কিশোর বলল, কিন্তু তাতে সূর্য পড়ে কিভাবে?
সূর্য ডোবার কথা বলেনি তো? রবিন বলল।
সেটাও অসম্ভব, পুকুরে সূর্য ডোবে না।
তাহলে কথাটা হয়তো অন্য কিছু ছিল, মুখে মুখে বিকৃত হয়েছে।
তা হতে পারে, ঘন ঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। কথাটা হয়তো ছিল রোদ পড়েনা না, তা-ও না, রোদ পড়লে শুধু মাঝখানে পড়বে কেন? সারা পুকুরেই পড়বে। আরেকটা ব্যাপার হতে পারে, পুকুরের মাঝখানে সূর্যের। প্রতিবিম্ব পড়াকে বুঝিয়েছে। তীরে দাঁড়িয়েই হয়তো দেখা যায় সেটা।
ঠিক বলেছ! নিজের উরুতে চাপড় মারল রবিন। দুপুর বেলা পুকুরে সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়তেই পারে। পুকুরটা খুঁজে বের করব। তারপরের ধাঁধাটা?
তারপর পশ্চিমে দেখতে পারে অস্তপ্রায় চন্দ্র, পড়ল কিশোর।
নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ল রবিনের। এইটা কি ভাবে সম্ভব? এর কোন মানেই হয় না। ধরা যাক, পুকুরটা আমরা খুঁজে পেলাম, যাতে ঠিক দুপুরে সূর্যের প্রতিবিম্ব পড়ে। কিন্তু ওই সময় চাঁদ দেখব কি করে, তা-ও পশ্চিমে, আবার অস্তগামী? তারও ওপর রয়েছে জঙ্গল, উঁচু উঁচু গাছ, সত্যি সত্যি যখন অস্ত যায়, তখনও তো দেখা যাবে না।
ভূগোলের কোন গোলমাল হয়তো আছে ওই এলাকায়, মিনমিন করে বলল মুসা।
আরে দূর! ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিল যেন রবিন। যত ভৌগোলিক গোলমালই হোক, দুপুরবেলা চাঁদ ডুবতে দেখা যায় না।