জিম, চ্যাকো আর ওরটেগা ফিরে যেতে পারলে আমাদের উদ্ধার করবে, সব শেষে বলল জিনা।
অনেকগুলো যদি আছে তাতে। যদি ফিরে যেতে পারে, যদি উদ্ধার করার ইচ্ছে থাকে, এবং যদি ওরা আসার আগেই আমাদের বলি না দিয়ে দেয় ইনডিয়ানরা, মুসা বলল।
অত নিরাশ হও কেন? সান্ত্বনা মুসাকে নয়, নিজেকেই দিল আসলে কিশোর।
দীর্ঘ নীরবতা।
ক্যাসাডো ভাবছে।
রবিন চুপ।
জিনা চিন্তিত।
মনিবের চেহারা দেখে রাফিয়ানও বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে, লেজ নাড়ছে ধীরে ধীরে।
হঠাৎ নীরবতা ভাঙল ক্যাসাডো, আমার প্লেনের রেডিওটা যদি খালি পেতাম। এসওএস পাঠানো যেত।
আমরা যে প্লেনে এসেছি, কিশোর বলল, তাতেও আছে রেডিও। ভাঙা, অর্ধেক মেরামত হয়েছে।
০৭.
তাই নাকি? ভুরু কোঁচকাল ক্যাসাডো। রেডিও?
অনেক চেষ্টা করেছি আমি আর ওরটেগা, জানাল কিশোর। ঠিক করতে পারিনি।
আমি একবার দেখতে পারলে হত, বলল ক্যাসাডো।
এখান থেকে অনেক দূরে, বিশেষ আশাবাদী হতে পারল না জিনা।
না, বেশি দূরে নয়। প্লেনটা কোথায় পড়েছে, অনুমান করতে পারছি। ওই ইয়ারা নদী আর পাহাড়ের কথা যে বলছ, আমার চেনা। শর্টকাট আছে, এখান থেকে মাত্র এক ঘণ্টা লাগে। অনেক এগিয়ে গিয়েছিলে তোমরা, ঘুরপথে, পিছিয়ে আনা হয়েছে আবার! আমি যাব প্লেনটা দেখতে।
বললেন না বেরোতে দেয় না? কিশোর মনে করিয়ে দিল।
দেয় না মানে, জিভারোদের ছেড়ে চলে যেতে দেবে না। কিন্তু গায়ের বাইরে বেরোনোতে নিষেধ নেই, অবশ্য একলা বেরোতে দেবে না। কতবার শিকারে। গেছি ওদের সঙ্গে। অনেক জায়গা চিনেছি।
তাহলে একলা যাবেন কি করে? আটকাবে না?
হাসল ক্যালাডো। আসলে একা বেরোনোর চেষ্টাই করিনি কখনও। একলা। পালাতে পারব না, জঙ্গলে মরব, তাই। তবে চেষ্টা করলে যে ওদের চোখ এড়িয়ে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে আসতে পারব না, তা নয়।
গত কয়েক দিনের তুলনায় সে-রাতে ভাল ঘুম হলো ছেলেদের।
পরদিন সকালে ঝরঝরে শরীর-মন নিয়ে ঘুম ভাঙল।
রোজ নাস্তা নিয়ে আসে সে মেয়েমানুষটা, সে-ই নিয়ে এল সেদিনও। ঝুড়ি নামিয়ে রেখে চলে গেল।
একটা পেঁপের নিচে ভাজ করা একটা কাগজ পাওয়া গেল। ক্যাসাডো লিখেছে :
কাল রাতে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। প্লেনটা খুঁজে পেয়েছি। একটা ভুল করেছিল ওরটেগা, রেডিওর একটা পার্টস উল্টো লাগিয়েছিল, ফলে ঠিক হয়নি। সেটা মেরামত করেছি। রেডিও কাজ করছে এখন। এসওএস-ও পাঠিয়েছি একটা। জবাব পাইনি। সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছি। আবার গিয়ে মেসেজ পাঠানোর চেষ্টা করব।
–ক্যাসাডো।
খবর শুনে এত খুশি হলো, বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ নেচে নেয়ার লোভ সামলাতে পারল না মুসা আর জিনা। তাড়াহুড়ো করে নাস্তা সেরে কুঁড়ের বাইরে বরোল। নাচতে শুরু করল। তাদের সঙ্গে যোগ দিল রাফিয়ান। তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছে, সেই সাথে ঘেউ ঘেউ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার যোগাডু কিশোর আর রবিনের।
এই মজার কাণ্ড ইনডিয়ান ছেলেমেয়েদেরও দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করল। পায়ে। পায়ে এগিয়ে এল ওরা। কাছে এসে সাহস পেয়ে তারাও যোগ দিল নাচে।
এল সর্দার হামুর ছেলে পুমকা। বয়েস যোলো। খুব ভদ্র, শান্ত। তাকে অপছন্দ করার জো নেই। সে-ও নাচতে শুরু করল, হাসছে হা-হা করে।
এত হই-হল্লা কিসের! সর্দার মনে করল, সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে গেছে। কুঁড়ের দরজায় উঁকি দিল সে। দেখল, দেবতার ছেলেদের সঙ্গে তার ছেলের ভাব। হয়েছে। খুব খুশি হলো সে। হেসে, আপনমনে মাথা দুলিয়ে আবার ভেতরে চলে গেল।
নাচতে নাচতেই কনুই দিয়ে মুসার পাঁজরে গুঁতো মারল জিনা। বোঝে এবার। এদের ভয়েই কিনা আমরা কেঁচো হয়ে ছিলাম। এই জিভারোদের মত ভদ্র জংলী–আর হয় না।
তা হোক, মুসা বলল। তবু আমি থাকতে চাই না এখানে। দেখা যাক, ক্যাসাডোর এসওএস-এর জবাব আসে কিনা।
কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে ছেলেরা। ফলে মনের ভার অনেকখানি। হালকা হয়েছে। সহজ ভাবে ইনডিয়ানদের সঙ্গে মিশতে পারছে।
প্রায় প্রতিদিনই ক্যাসাডোর সঙ্গে তার কুঁড়েতে দেখা হয়। আলাপ-আলোচনা হয়। সুযোগ পেলেই প্লেনে গিয়ে এসওএস পাঠায় বৈমানিক। যদিও একটা জবাবও আসেনি এখনও।
সময় কাটাতে এখন আর তেমন অসুবিধে হয় না গোয়েন্দাদের। ইনডিয়ান। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ভাব হয়েছে। বন্ধুত্ব হয়েছে পুমকার সঙ্গে। তার কাছে। জিভারো ভাষা শিখছে ওরা। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কাজ চালানোর মত ভাষা শিখে ফেলল দুতরফই। মোটামুটি আলাপ করতে পারে। আর এই আলাপের মাধ্যমেই একদিন অদ্ভুত কিছু কথা শুনল অভিযাত্রীরা।
ভালমত বুঝিয়ে বলতে পারল না পুমকা, তত শব্দ দু-তরফের কারও স্টকেই জমা হয়নি এখনও। স্পষ্ট বোঝা গেল শুধু চারটে শব্দ : গুপ্তধন, মন্দির, চাঁদ এবং উপত্যকা।
কান খাড়া হয়ে গেল কিশোর পাশার। অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করল পুমকাকে, বোঝানোর চেষ্টা করল।
পুমকা বুঝল ঠিকই, কিন্তু বলতে পারল না। আবার একই কথা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, গুপ্তধন। মন্দির। চাঁদ।
নাহ, হবে না, হতাশ হয়ে মাথা নাড়ল কিশোর। ক্যাসাডোকে জিজ্ঞেস করে দেখি, কিছু বলতে পারেন কিনা।
ছেলেদের আগ্রহ দেখে হাসল ক্যাসাডো।
পুরানো একটা জিভারো কিংবদন্তী, বলল সে। সব কিংবদন্তীই তিল থেকে তাল হয়, তবে তিল একটা থাকে। এটাতেও বোধহয় রয়েছে। কোন্ কথাটা সত্যি আর কোনটা রঙ চড়ানো বোঝা মুশকিল। জঙ্গলের পরে এক পাহাড়ী উপত্যকায় অনেক পুরানো একটা মন্দির আছে, নাম চন্দ্রমন্দির। ইনকাদের মত একটা সভ্য। জাতির বাস নাকি ছিল ওখানে, এখনও আছে ধ্বংসস্তূপ। সেখানেই আছে গুপ্তধন বা। মূল্যবান কিছু। সম্ভবত দামী ধাতুর তৈরি দেব-দেবীর মূর্তি।