বিকেলে গাঁয়ের ভেতর বেড়াতে বেরোল ওরা। ওঝার কুঁড়ের ধার দিয়ে। যাচ্ছে, এই সময় দুজন মেয়ের একজন বেরিয়ে হাত নেড়ে ডাকল তাদের।
দরজায় দেখা দিল ওঝা বিটলাঙগোরগা। ইশারা করল।
বিটলা ডাকছে কেন? মুসার প্রশ্ন।
বিটলামী করার জন্যে, জিনার জবাব।
তোমরা বেশি কথা বলো! কড়া ধমক লাগাল কিশোর।
যেতে দ্বিধা করছে ছেলেরা।
ভয় কি? এসো, ইংরেজিতে বলল কেউ।
ঝট করে তাকাল সবাই। কে? ওঝা ছাড়া ধারেকাছে তো আর কেউ নেই? ইনডিয়ান মেয়েটাও ঢুকে গেছে আবার কুঁড়েতে।
দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল ওঝা। ছেলেদের ভেতরে ঢোকার পথ করে দিল। তারপর মেয়েদুটোকে কিছু বলল, বেরিয়ে গেল ওরা।
ছেলেরা ঢুকলে দরজা লাগিয়ে দিল ওঝা। আস্তে করে খুলে আনল মুখোশ।
ইওরোপীয়ান! চেঁচিয়ে উঠল বিস্মিত মুসা।
আপনি ইংরেজি বলেছেন? রবিনের জিজ্ঞাসা।
কে আপনি? জানতে চাইল জিনা।
কিশোর তেমন অবাক হয়েছে মনে হলো না, এ-রকম কিছুই যেন আশা করছিল সে।
হাসল ওঝা। বয়েস পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে, ধূসর চুল, হাসি হাসি নীল চোখ। মুখের চামড়া ফ্যাকাসে, সর্বক্ষণ মুখোশ পরে থাকে বলেই হয়তো। খুব চমকে। দিয়েছি, না? আসলে আমি বিটলাঙগোরগার অভিনয় করছি, বিটলা নই। শব্দ করে হাসল সে।
কত কত বাজে কথা বলেছে ভেবে লজ্জা পেল মুসা আর জিনা, চোখ তুলে তাকাতে পারল না।
আমার নাম কারলো ক্যাসাডো। ছিলাম বৈমানিক, কপাল-দোষে হয়ে গেলাম। জিভারোদের ওঝা।
আপনাকে আমি চিনেছি, স্যার, কিশোরের কণ্ঠে উত্তেজনা। আপনিই সেই বিখ্যাত কারলো ক্যাসাডো, দুর্ধর্ষ বৈমানিক হিসেকে যার অনেক নামডাক। আপনার অনেক অভিযানের কাহিনী আমি পড়েছি। আপনার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদও…
পড়েছ, না? এই রাজিলের। জঙ্গলেই হারিয়েছি আমি, বিষণ্ণ শোনাল। বৈমানিকের কণ্ঠ।
কি হয়েছিল? জিজ্ঞেস করল জিনা।
এঞ্জিনের গোলমাল। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল প্লেন। বেঁচে যে আছি এটাই আশ্চর্য। প্যারাসুটও আটকে গিয়েছিল, খুলল শেষ মুহূর্তে। আরেকটু দেরি হলেই গেছিলাম। পড়লাম একেবারে জিভারোদের সর্দার হামুর কুঁড়ের সামনে। ভেবেছি, সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কেটে ফেলবে। তা-তো করলই না, আমাকে তোয়াজ শুরু করল। পরে বুঝেছি, নীল চোখ আর আকাশ থেকে পতনই আমাকে বাঁচিয়েছে। আমাকে ওরা কালুম-কালুম ভেবেছে।
কালুম-কালুম! মুখ বাঁকাল মুসা।
জিভারো ইনডিয়ানদের পবন, কিশোর বলল তাকে। বাতাসের দেবতা।
বাহ, বুদ্ধিমান ছেলে, প্রশংসা করল ক্যাসাডো। অনেক কিছু জানো।
ইনডিয়ানরা প্লেন দেখেনি? জিজ্ঞেস করল রবিন।
দেখে, মাঝে-সাঝে। জঙ্গলের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। কিন্তু ওগুলো কি জিনিস, জানে না ওরা। সভ্যতার সঙ্গে পরিচয় নেই। আর প্যারাসুট তো দেখেইনি। আমার প্লেনটা গিয়ে পড়েছে ওখান থেকে অনেক দূরে, বাতাসে উড়িয়ে। নিয়ে এসেছে আমাকে।
ওদের ভুল ধারণা ভাঙলেন না কেন?
চেষ্টা করেছি, মানতে রাজি নয়। ওদের ধারণা, দেবতারা সহজে মানুষের। কাছে ধরা দেয় না, তাই নানা রকম বাহানা করে। আমি কালুম-কালুম যদি না-ও হই, তার প্রেরিত দূত যে তাতে কোন সন্দেহ নেই ওদের।
হেসে বলল মুসা, বাঘের সাজে যে সাজিয়েছেন আমাদের, আমরা তাদের কাছে কী? হালুম-হালুম?
হেসে ফেলল ক্যাসাডো। হালুম-হালুম না হলেও অনেকটা ওরকমই। দেবতার বাচ্চা।
ওদের ভাষা শিখলেন কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পর্তুগীজ ভাষার কিছু শব্দ মিশে গেছে ওদের ভাষায়। কিছু কিছু জিভারো জানতাম। শুরুতে কাজ চালিয়ে নিয়েছি। থাকতে থাকতে এখন পুরোপুরিই শিখে ফেলেছি।
আপনি চলে যান না কেন?
যেতে দেয় না। আমি নাকি ওদের সৌভাগ্যের ধারক। চলে গেলে আবার যদি দুর্ভাগ্য এসে ভর করে?
তাদের এ-বিশ্বাসের কারণ? রবিন জানতে চাইল।
আমি নেমেছিলাম সর্দারের কুঁড়ের সামনে। এমন এক সময়, যখন জিভারোদের দুঃসময় চলছে। বনে শিকার নেই, প্রচণ্ড খরা। এমনিতেই খাবারের খুব সমস্যা বেচারাদের, খুরা কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়। খাওয়ার অভাব, লোক। মরছে। ওই সময় আমি নামলাম। যেদিন এলাম, অনেক দিন পর সেদিনই পাঁচট = শুয়োর মেরে আনল শিকারীরা, তার পরদিন থেকে শুরু হলো বৃষ্টি। আসনে আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখেই বনে জন্তু-জানোয়ারেরা ফিরে আসা শুরু করেছিল। ইনডিয়ানরা ভাবল, সব আমার দয়া। আমি বলেছি বলেই খাবার আর পানি দিয়েছে কালুম-কালুম। এ-রকম একজনকে কেন ছেড়ে দেবে ওরা?
তা-তো ঠিকই, মুসা বলল। আমরা কালুম-কালুমের ছেলে, বলেছেন বুঝি তাদের?
তোমাদের ভালর জন্যেই বলতে হয়েছে, হাসল বৈমানিক। সারাক্ষণ মুখোশ পরে থাকেন কেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
থাকতেই হবে যখন, ভাবলাম ক্ষমতা নিয়েই থাকব। দেবতারা নাকি সহজে নিজেদের চেহারা মানুষকে দেখতে দিতে চায় না। তাই মুখোশ বানালাম। একমাত্র সর্দারের সামনে ছাড়া আর কারও সামনে খুলি না। এতে হামুও খুব খুশি, তাকে অনেক বড় সম্মান দেয়া হয়েছে বলে।
পালানোর কথা ভাবেন না?
ভাবি না মানে? পালাতে পারলে বাঁচি। কিন্তু এই গভীর জঙ্গল পেরিয়ে একা। যাব কি করে? সভ্যতা অনেক দূর। সাহস হয় না। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, কিন্তু তোমাদের কথা তো কিছু জানা হলো না? কে তোমরা? কি করে এলে?
খুলে বলল সব কিশোর। মাঝে মাঝে কথা যোগ করল অন্য তিনজন।