কুঁড়ের সামনের আঙিনায় লোকের ভিড়, মেয়ে-পুরুষ-বাচ্চারা সবাই চেয়ে রয়েছে এদিকে। ইশারায় গ্রামবাসীকে বুঝিয়ে দিল ওঝা, বন্দিদেরকে তার দায়িত্বে নিয়েছে।
তিক্ত কণ্ঠে রসিকতা করল মুসা, মাকড়সা বলছে মাছিকে : আমার বাড়ি এসো বন্ধু বসতে দেব… বিড়বিড় করে আরও কিছু বলল, বোঝা গেল না। তারপর ওঝার দিকে চেয়ে বলল, গলায় যা একেকখান দাঁত ঝুলিয়েছ না, জংলীদাদা। মানুষের গোশত খাওয়ার সময় ওগুলো লাগিয়ে নাও নাকি?
আহ, চুপ করো! বিরক্ত হয়ে ধমক দিল কিশোর। বিপদ আরও বাড়াবে। দেখছি!.
ছেলেদেরকে তার কুঁড়েতে নিয়ে এল ওঝা। দেয়ালে দেয়ালে ঝলছে নানা আকৃতির অসংখ্য মুখোশ, একেকটার মুখভঙ্গী একেক রকম। আরও নানারকম অদ্ভুত জিনিস রয়েছে, তার মাঝে নরমুণ্ড শিকারী ইনডিয়ানদের তৈরি মানুষের মাথার সঙ্কুচিত ট্রফিও আছে।
এই গল্প নিয়ে দারুণ একখান অ্যাডভেঞ্চার ফিল্ম করতে পারবেন মিস্টার ক্রিস্টোফার, মুসা বলল।
না তা পারবেন, মাথা দোলাল জিনা। কিন্তু আগে আমাদের বেঁচে ফিরে তো যেতে হবে?
অপার্থিব লাগছে ঘরের পরিবেশ। ওঝাকেও কেমন যেন মেকি মনে হচ্ছে। কিশোরের কাছে। কেন, বলতে পারবে না। পুরো ব্যাপারটাই যেন সাজানো অভিনয়।
ঘরে দুজন ইনডিয়ান মেয়ে আছে। কর্কশ কণ্ঠে তাদের কিছু বলল ওঝা।
হাত ধরে নিয়ে ছেলেদের বসাল ওরা। প্রত্যেকের গালে লাল আর হলুদ রঙের আলপনা একে দিল। চামড়ার তৈরি খাটো আলখেল্লা পরতে দিল, সেগুলোতেও লাল-হলুদ আঁকিবুকি। রাফিয়ানের মুখেও কয়েকটা রঙিন পোচ লাগিয়ে দিল একটামেয়ে।
সাজানো শেষ হলে ছেলেদের আবার বাইরে নিয়ে এল ওঝা, অপেক্ষমাণ জনতাকে দেখাল।
সন্তুষ্টির গুঞ্জন উঠল জনতার মাঝে।
কুঁড়েতে ফিরে গেল আবার ওঝা।
যার যার কাজে গেল জনতা। একা হয়ে গেল ছেলেরা। কেউ নেই তাদের কাছে, কোন পাহারাদার নেই।
ব্যাপার কি? মুসা না বলে থাকতে পারল না। মাথামুণ্ড তো কিছুই বুঝছি না।
মুক্তি দিল নাকি? রবিনের প্রশ্ন।
না, মাথা নাড়ল কিশোর, আমার মনে হয় না ব্যাপারটা এত সহজ। নিশ্চয় কোন কারণ আছে এসবের।
মরুকগে! মুখ ঝামটা দিল জিনা। গালে রঙ চড়চড় করছে। চলো, ধুয়ে ফেলিগে।
দাঁড়াও, বাধা দিল কিশোর। অযথা লাগায়নি এগুলো। হয়তো কোন ধরনের ছাড়পত্র। এসো, পরীক্ষা করে দেখি।
ধীরে ধীরে হেঁটে গাঁয়ের একদিকের সীমানায় চলে এল ওরা। তারপরে জঙ্গল। সেদিকে পা বাড়াতেই পথরোধ করে দাঁড়াল পাহারাদার। চেহারায় কোনরকম। ভারান্তর নেই তার, কিছু বলল না।
সেদিক থেকে ফিরে এল ছেলেরা।
চারদিকেই গিয়ে দেখল। সব জায়গায় একই ব্যাপার ঘটল। বোঝা গেল, গায়ের মধ্যে ওরা স্বাধীন, কিন্তু সীমানার বাইরে বেরোতে দেয়া হবে না।
যাক, কিশোর বলল, কিছুটা স্বাধীনতা তো মিলল। সুযোগ বুঝে পালানোর চেষ্টা করব।
নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে বাধ্য হলো অভিযাত্রীরা। প্রথম দিনের সেই কুঁড়েটাতেই ঘুমায়। দিনের বেলা গ্রামের এখানে ওখানে কাটায়। কেউ কিছু বলে না।
তিন দিনের দিন তাদের ডাক পড়ল সর্দারের কুঁড়েতে। ওঝা তাদেরকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল। এক এক করে তাদের মাথায় হাত রেখে দ্রুত কিছু বলল সর্দারকে। একটা শব্দ কয়েকবার উচ্চারণ করল : হামু। কিশোরের ধারণা হলো, হামু সর্দারের নাম। সর্দারও একটা শব্দ বার বার বলল : বিটলাঙগোরগা।
মারছে রে। ওঝার নাম… নিচু স্বরে বলতে গিয়ে বাধা পেল মুসা। ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় তাকে থামিয়ে দিল কিশোর।
একটা ব্যাপার স্পষ্ট হলো, সর্দারের ওপর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে ওঝার। দীর্ঘ আলোচনা শেষে ওঝা আবার ছেলেদের নিয়ে বেরিয়ে এল। খুশি খুশি মনে হলো তাকে।
কুঁড়েতে ফিরে কিশোর বলল, ওঝার ব্যাপারে অদ্ভুত কিছু লক্ষ করেছ?
কিছু কি? সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল মুসা। পুরোটাই অদ্ভুত। ওরকম অদ্ভুত মানুষ জিন্দেগীতে দেখিনি।
ওকথা বলছি না। জিভারোদের সঙ্গে পার্থক্য রয়েছে ওর, ঠিক মেলে না।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রবিন, আমিও খেয়াল করেছি।
তা-তো হবেই, মুসা বলল আলাদাই যদি না হলো, ওঝা কিসের? বিচিত্র পোশাক, অদ্ভুত ব্যবহার আর একটু রহস্য রহস্য ভাব যদি বজায় না রাখে, কেন ভয় করবে লোকে?
আমার মনে হয়েছে, গাল ফুলিয়ে ভেঙচাল জিনা, আস্ত একটা ভাঁড়। একটা রামছাগল। শুধু জিভারো যোদ্ধাদের সঙ্গেই যা কিছুটা মিল রয়েছে:
কই আর মিল? মুসা বলল। সেজেগুঁজে যেতে দেখলাম তো কয়েকটাকে সেদিন।
ফিরে এল যোদ্ধারা। খালি হাতে। হাইজ্যাকারদের ধরতে পারেনি।
আশা হলো ছেলেদের। হয়তো সভ্যজগতে ফিরে যেতে পারবে জিম। তাহলে সাহায্য আসবে।
ওঝাকে নিয়ে আবার কথা উঠল।
আমি আসলে বোঝাতে চাইছি, কিশোর বলল। এ-গাঁয়ের জিভারোরা সাধারণ মানুষ। মনও তাদের ভাল। কিন্তু ওঝার স্বভাব, চালচলন কেমন যেন অন্যরকম। আর, সারাক্ষণ মুখে মুখোশ পরে রাখে কেন?
হয়তো চেহারা খুব কুৎসিত, মুসা বলল। কিংবা মুখে বাজে কোন চর্মরোগ। আছে। অথবা মুখে খোলা বাতাস লাগানো পছন্দ করে না সে।
এমনও হতে পারে, কর্তৃত জাহির করার জন্যেই মুখোশ পরে সে রবিন বলল। কিংবা অলৌকিক কোন ক্ষমতা আছে ওটার।
ওসব হয়তো-টয়তোর ধার দিয়ে গেল না জিনা, সাফ বলে দিল, ওর মুখটা আসলে তাপিরের মত, তাই ঢেকে রাখে।