সেটা পরে দেখা যাবে, ভেবে পকেট থেকে নোটবই বের করে একটা পাতা ছিঁড়ে নিল কিশোর। লিখে, কাগজটা ভাজ করে জিনার হাতে দিল।
আস্তে শিস দিয়ে রাফিয়ানকে ডাকল জিনা। কুকুরটা ফিরে এলে তার কলারে শক্ত করে কাগজটা আটকে দিল। রাফি, এটা জিমকে দিয়ে আয়।
একবারেই বুঝল বুদ্ধিমান কুকুরটা। বেরিয়ে গেল। ফিরে এল খানিক পরে। কলারে আটকানো আরেকটা কাগজ।
খুলে জোরে জোরে পড়ল কিশোর :
হুট করে কিছু কোরো না। যেখানে রয়েছ, থাকো। আমরা পালানোর উপায় খুঁজছি। আধঘণ্টা পর রাফিকে পাঠাবে।
অপেক্ষার পালা।
আধ ঘণ্টাই অনেক বেশি মনে হলো। রাত বেশি বাকি নেই। অন্ধকার। থাকতে থাকতে না পারলে পরে কঠিন হয়ে যাবে পালানো।
অবশেষে রাফিয়ানকে আবার পাঠানোর সময় হলো।
আরেকটা নোট নিয়ে ফিরে এল রাফিয়ান। খুলে পড়ে বোকা হয়ে গেল ছেলেরা। জিম লিখেছে:
আমরা তিনজন যাচ্ছি। তোমাদের নিতে পারছি না, কারণ, তাতে আমাদের চলা ধীর হয়ে যাবে। নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করব। পারলে, যত তাড়াতাড়ি পারি সাহায্য নিয়ে ফিরে আসব তোমাদেরকে উদ্ধার করার জন্যে। চিন্তা কোরো না। সাহস হারিয়ো না।
ইয়াল্লা! মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল মুসা। আর কোন উপায় নেই। জংলীদের টফির জন্যে মাথাটা বুঝিখোয়াতেই হলো।
অন্য সময় হেসে ফেলত ওরা, কিন্তু এখন ভাবনা বড় বেশি।
পালানোর আশা শেষ। চুপ করে থাকা ছাড়া আর উপায় কি? এই অবস্থায় ঘুম আসার প্রশ্নই ওঠে না। বেড়ায় হেলান দিয়ে কান পেতে রইল ওরা, হাইজ্যাকারদের পালানোর শব্দ শোনার জন্যে।
সময় যাচ্ছে। নীরবতায় কোন রকম ছেদ পড়ল না। তাহলে কি পালানোর চেষ্টা করছে না ওরা? নাকি ইতিমধ্যেই বেরিয়ে গেছে, নিঃশব্দে?
পুব আকাশে আলোর আভাস দেখা গেল। ফিকে হতে শুরু হলো অন্ধকার, ভোর হয়ে আসছে। জিভারোদের কুঁড়ের সামনে আগুন নিভু নিভু হয়ে এসেছে, সেগুলোতে কাঠ ফেলে আবার বাড়িয়ে দেয়া হলো। কেউ কেউ আর ঘরে ঢুকল না, হাঁটাহাঁটি করতে লাগল, ভোরের তাজা হাওয়া গায়ে মাখছে।
আলো বাড়ল।
হঠাৎ ঝটকা দিয়ে পাল্লা পুরো খুলে গেল। কুঁড়েতে ঢুকল একটা মেয়েলোক। হাতে বেতের ঝুড়িতে ফল। নীরবে ঝুড়িটা ছেলেদের সামনে নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
এসো, নাস্তা, ডাকল কিশোর। ইস, এক প্লেট ডিম ভাজা আর রুটি যদি পেতাম।
যা পাওয়া গেছে তাই বা মন্দ কি? দুহাতে দুটো ফল তুলে নিল মুসা, কটাস করে এক কামড়ে অর্ধেকটা মুখে নিয়ে চিবাতে শুরু করল। আঁউম, বেশ মিষ্টি, মুখ খাবারে বোঝাই থাকায় শোনাল বেম্মিট্টি।
হঠাৎ শোনা গেল চেঁচামেচি। মেয়ে কণ্ঠ। কথা বোঝা গেল না অবশ্যই।
দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল ছেলেরা, কয়েকজন যোদ্ধা ছুটে যাচ্ছে খানিক দূরের আরেকটা কুড়ের দিকে। ওটাতেই রাখা হয়েছিল হাইজ্যাকারদের। শোরগোল বাড়ল। দেখতে দেখতে পুরো গ্রাম এসে ভিড় জমাল কুঁড়ের সামনে।
পালিয়েছে তাহলে! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুসার চেহারা। দেখেছ কেমন রেগে গেছে? সব ঝাল না এসে আমাদের ওপর ঝাড়ে এখন ব্যাটারা।
.
০৬.
দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছে ছেলেরা, ইনডিয়ানরা কি করে।
একদল জিভারো যোদ্ধা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি হয়ে চলে গেল জঙ্গলের দিকে। কেন গেছে, সেটা আর বলে দিতে হলো না ছেলেদের, বুঝল। পলাতকদের কি ধরতে পারবে?
জঙ্গলের ভেতর মিলিয়ে গেল যোদ্ধাদের শোরগোল। গাঁয়ের লোকেরা দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হলো। কেউ এল না ছেলেদের ঘরের দিকে। আস্তে আস্তে অস্বস্তি দূর হলো ওদের।
মেয়েলোকটা নিশ্চয় বলেছে যে, ছেলেরা কুঁড়েতে রয়েছে। যুক্তি মানে, এমন। কেউ ভাববে না, তিনজন লোকের পালানোর ব্যাপারে ছেলেদের কোন যোগসাজশ রয়েছে। কিন্তু কথা হলো, যুক্তি কতখানি মানে কিংবা বোঝে জিভারোরা?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসা। আল্লাই জানে কি হবে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। গতরাতে যে পাহারায় ছিল, সেই লোকটা এল। চেহারা দেখে ভালমন্দ কিছু বোঝা গেল না। ইশারায় বাইরে বেরোতে বলল তাদেরকে।
কুঁড়ে থেকে বেরোল ছেলেরা। লোকটার পিছু পিছু সর্দারের কুঁড়ের দিকে এগোল।
কিন্তু সর্দারের কুঁড়েতে না গিয়ে কাছের আরেকটা বড় কুঁড়েতে তাদেরকে নিয়ে এল লোকটা। কুঁড়ের কাছ থেকে বড় জোর দশ কদম দূরে রয়েছে ওরা, এই সময় দরজায় দেখা দিল অদ্ভুত দর্শন এক মুর্তি।
আর দশজন সাধারণ জিভারোর চেয়ে লম্বা, বিকট মুখোশে মুখ ঢাকা। মাথার বন্ধনীতে লম্বা লম্বা পালক গোঁজা। জানোয়ারের চামড়ায় তৈরি বিচিত্র পোশাক পরনে। পালক আর পশুর দাঁতের তৈরি লম্বা মালা কয়েক প্যাঁচ দিয়ে রেখেছে গলায়।
রবিন জানে, বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে ওই ধরনের পোশাক, মুখোশ আর মালা পরে জংলী ওঝারা। তাহলে এখন কি কোন বিশেষ অনুষ্ঠান হবে? কি সেটা? ইনডিয়ানদের নিষ্ঠুর কোন দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেয়া হবে বন্দিদের?
অনেকক্ষণ নীরবে একদৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে রইল ওঝা। তারপর এগিয়ে এসে আস্তে করে হাত রাখল কিশোরের মাথায়। তার ব্যবহারে ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই। একে একে, মুসা, রবিন আর জিনার মাথায়ও একইভাবে হাত রাখল সে।
আর দাঁড়াল না পাহারাদার, বোধহয় থাকার প্রয়োজন মনে করল না। ঘুরে। চলে গেল।
ওঝার সঙ্গে বন্দিরা একা। অনুমান করতে কষ্ট হলো না, ওই অদ্ভুত লোকটা তাদেরকে তার ছত্রছায়ায় নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তাতে এখুনি খুশি হওয়ার কিছু নেই। কেন নিয়েছে কে জানে?