গোটা দুই হোট মশাল জ্বলছে কুঁড়েতে। আধার কাটছে না। সেই ম্লান। আলোয় পরস্পরের দিকে তাকাল চারজনে।
ভাল বিপদে পড়েছি, মুখ খুলল মুসা। বেরিয়েছিলাম বেড়াতে আহ, কি একখান বেড়ান বেড়াচ্ছি। স্বপ্নেও ভাবিনি কখনও এরকম হবে, তাহলে কি আর বেরোই? প্লেন হাইজ্যাক, জঙ্গলের মাঝে ক্রাশ-ল্যাণ্ডিং তারপর এসে পড়লাম নরমুণ্ড শিকারীদের কবলে।
তো-ত্তুমি কি সত্যি মনে করো… কথা আটকে যাচ্ছে রবিনের, ওরা আমাদের মাথা কেটে ট্রফি বানাবে? পায়ের গোড়ালিতে হাত বোলাল সে।
তোমার কি মনে হয়? পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর।
বইয়ে তো পড়েছি অন্যরকম, এক মুহূর্ত চুপ রইল রবিন। কিন্তু বইয়ের সঙ্গে বাস্তবের মিল কতখানি আছে কে জানে। আজকাল নাকি নরমুণ্ড শিকারী আর নেই। জিভারোরা মানুষের মাথার ট্রফি এখনও রাখে শুনেছি-কিন্তু অভিজ্ঞ ভ্রমণকারীদের ধারণা, সেগুলো জ্যান্ত মানুষের মাথা কেটে নয়, যারা মরে যায়, তাদের।
আমিও শুনেছি, কিশোর বলল। মরা মানুষেরই হোক আর জ্যান্ত মানুষেরই হোক, ব্যাটারা ট্রফি বানায়, তাতে কোন সন্দেহ নেই। মিউজিয়মে ওরকম একটা ট্রফি দেখেছি, অনেক পুরানো মানুষের। মাথার আসল আকার নেই, ছোট করে ফেলেছে, একটা টেনিস বলের সমান।
মারছে রে! দেখতে কেমন? জিজ্ঞেস করল মুসা।
খুব খারাপ। গা গুলিয়ে ওঠে।
অত ছোট করে কি করে? জিনা জানতে চাইল।
হাড়-মগজ-মাংস সব বের করে ফেলে। চুল ঠিকই রাখে। তারপর চামড়া শুকাতে শুকাতে এমন অবস্থায় নিয়ে আসে…
থাক থাক, আর বলার দরকার নেই, যথেষ্ট হয়েছে, বাধা দিল মুসা। আমাদের পালানো উচিত, যত জলদি পারা যায়। জংলীদের বিশ্বাস নেই। মরা মানুষের মাথা কাটে বলেছে তো? আমিও বিশ্বাস করি। কাজটা খুবই সহজ। জ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেললেই মরে যায়, তখন আর মাথা কেটে নিতে অসুবিধে কোথায়। বই লেখে যারা, ওসব ধড়িবাজ শিকারী আর ভ্রমণকারীদের কথা ছাড়ো।
কিন্তু পালাই কিভাবে? নিচের ঠোঁটে বার দুই চিমটি কাটল কিশোর। পালিয়ে যাবই বা কোথায়? বড়জোর গিয়ে প্লেনটায় উঠতে পারব। জিম আর তার সঙ্গীদেরও বের করে নিয়ে যেতে হবে। ওদেরকে ছাড়া মাইলখানেও টিকব না এই জঙ্গলে। ধরো, এত কিছু করে পালাতে পারলাম। কিন্তু তারপর কি হবে? আমাদের পিছু নিয়ে ঠিক প্লেনের কাছে হাজির হয়ে যাবে ইনডিয়ানরা, আবার ধরে আনবে।
কিন্তু তাই বলে চুপ করে থাকলে তো হবে না। কিছু একটা করা দরকার।
দেখো আগে এ-ঘর থেকেই বেরোতে পারো কিনা, হাত ওল্টাল কিশোর। তারপর তো অন্য কথা।
দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখল জিনা আর মুসা। কিশোর আর রবিন বসে রইল, অযথা কষ্ট করতে গেল না। ইনডিয়ানদের এসব কুঁড়ে সম্পর্কে প্রায় সবই জানা আছে ওদের, বইয়ে পড়েছে। শক্ত সোজা গাছ কেটে গায়ে গায়ে লাগিয়ে গভীর করে মাটিতে পোতা হয়। ওগুলোকে মজবুত করে বাধা হয় পাকা বেত দিয়ে। বোমা মারলেও ওই গাছের বেড়ার কিছু হবে কিনা সন্দেহ, আর ছেলেদের সঙ্গে তো রয়েছে শুধু সাধারণ ছুরি। বেতই কাটতে পারবে নাঃ থাকতো গাছ কাটা।
মাটির মেঝে, কিন্তু নিয়মিত লেপে লেপে সিমেন্টের মত শক্ত করে ফেলা। হয়েছে। সুড়ঙ্গ কেটে যে নিচ দিয়ে বেরোবে, তারও উপায় নেই।
বেড়া দেখা শেষ। বাকি রইল দরজা।
কিন্তু দরজায় ঠেলা দিয়েই অবাক হয়ে গেল জিনা। খোলা। শুধু ভেজিয়ে রেখে গেছে।
বিশ্বাস হচ্ছে না তার। আস্তে করে ঠেলে ফাঁক করল খানিকটা। উঁকি দিয়ে। দেখল, অনেক কুড়ের সামনে আগুন জ্বলছে। লালচে আলোয় আলোকিত হয়ে আছে পুরো এলাকাটা।
খুব সাবধানে, নিঃশব্দে দরজা আরেকটু ফাঁক করল জিনা। বাকি তিনজনও এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে, না না, চারজন, রাফিয়ানও।
এদিক ওদিক চেয়ে আস্তে বাইরে পা রাখল মুসা।
সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ছায়া থেকে উদয় হলো একটা মূর্তি। একজন জিভারো যোদ্ধা। আগুনের আলোয় লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে, তাতে ভয়াল কিছু নেই। শান্ত।
আবার পিছিয়ে এসে কুঁড়েতে ঢুকল মুসা। কেন দরজা বন্ধ করেনি ইনডিয়ানরা, বোঝা গেল।
দরজাটা ফাঁকই রইল। ছেলেরাও বন্ধ করল না, পাহারাদারও না।
বুঝলে তো? কিশোর বলল। পালাতে পারব না।
বন্ধ কুঁড়েতে রাফিয়ানের আর ভাল লাগল না। দরজা খোলা পেয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে গেল খানিক হাঁটাহাঁটি করে আসার জন্যে। ফিরেও তাকাল না পাহারাদার। তার ওপর নির্দেশ রয়েছে ছেলেদের দেখে রাখার জন্যে, কুকুর থাকল না গেল, তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই।
একটা মতলব এল কিশোরের মাথায়।
শোনো, নিচু স্বরে বলল সে। রাফিকে দিয়ে জিমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারি আমরা।
কি ভাবে? প্রায় একসঙ্গে প্রশ্ন করল অন্য তিনজন।
সহজ। একটা নোট লিখে রাফির গলায় বেঁধে দেব। বললেই দিয়ে আসবে সে।
কি লিখব, আমরা পালানোর ঝুঁকি নিতে চাই? আমার বিশ্বাস, ওদের দরজাও আটকানো নেই। কি নীরব দেখছ না? ইনডিয়ানরা সব ঘুমাচ্ছে, মাত্র দুজন পাহারাদার ছাড়া সবাই। একজন আমাদের কুড়ে পাহারা দিচ্ছে, আরেকজন ওদের। একই সঙ্গে দুজনকে ধরে যদি কাবু করে ফেলতে পারি, তাহলেই হলো।
খুব রিস্কি মনে হচ্ছে, রবিন বলল।
যে অবস্থায় পড়েছি, রিস্ক তো নিতেই হবে। পাহারাদারকে কাবু করার কথা বলল বটে কিশোর, কিন্তু কিভাবে করবে সেটা এখনও জানে না। আক্রান্ত হলে নিশ্চয় চেঁচামেচি করবে সে, সারা গ্রাম জাগিয়ে ছাড়বে। তখন?