আমি আর মুসাও পাহারা দিতে পারব, কিশোর প্রস্তাব রাখল।
না না, দরকার নেই। তোমরা ঘুমাও। প্রয়োজন হলে বলব।
শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল সবাই। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে। ছেলেরা। জিনার গা ঘেঁষে আছে রাফিয়ান। চোখ বোজা, কিন্তু কান খাড়া। সামান্যতম শব্দ হলেই জেগে যাবে।
কিন্তু এতবড় একটা জঙ্গলেও জাগিয়ে দেয়ার মত কোন শব্দ ঢুকল না। রাফিয়ানের কানে। খালি মশার বিরক্তিকর একঘেয়ে গান, আর আগুনে কাঠ। পোড়ার মৃদু চড়চড় ছাড়া আর কোন আওয়াজই নেই। ও হ্যাঁ, আছে, নিঃশ্বাসের শব্দ। আর মশার ঘ্যানর ঘ্যানরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাক ডাকাচ্ছে চ্যাকো।
কমে আসছে দেখে আগুনে কয়েকটা কাঠ ফেলল ওরটেগা। পাহারা দেবে। কি? সারাদিনের অমানুষিক পরিশ্রমে তার চোখও ঢুলুঢুলু, টেনে মেখের পাতা খোলা রাখতে পারছে না। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, টেরও পেল না।
ঘুম ভেঙে গেল মুসার। মাথা তুলে রাফিয়ানের দিকে চেয়ে দেখল, সে-ও সতর্ক হয়ে উঠেছে। চোখ মেলা। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে জঙ্গলের দিকে।
কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে জঙ্গলের দিকে তাকাল মুসা। কিছুই দেখল না। শব্দ একটা হয়েছে, সে নিশ্চিত। নাহলে ঘুম ভাঙল কেন?
বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হলো না। চারপাশে হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল জঙ্গল।
ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে এল একদল মানুষ। সে-কি বিকট চিৎকার ওদের। হাতে বল্লম। কয়েকজনের কাছে পুরানো আমলের বন্দুক। ঘিরে ফেলল অভিযাত্রীদের।
জিভারো! ফিসফিসিয়ে বলল আতঙ্কিত চ্যাকো। এবার আর রসিকতা নয়। কিছুই করতে পারল না অভিযাত্রীরা। দেখতে দেখতে বুনো লতা দিয়ে শক্ত করে বেধে ফেলা হলো ওদের। দুই হাত দুই পাশে রেখে বুক আর পিঠের ওপর। দিয়ে এমনভাবে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধেছে, হাত নড়ানোরও উপায় রইল না।
০৫.
ভয়ে দুরুদুরু করছে সবার বুক। কিন্তু রাফিয়ানের কথা আলাদা। সে ভয় পেল না। বন্ধুদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে দেখে ভীষণ রেগে গেল। লাফিয়ে পড়তে গেল একজন ইনডিয়ানের ওপর।
না, রাফি, না! চেঁচিয়ে উঠল জিনা। রাফি, খবরদার, মেরে ফেলবে! চোখের সামনে তার প্রিয় কুকুরটাকে খুন হতে দেখতে পারবে না সে।
কি বুঝল রাফিয়ান কে জানে, আর আক্রমণের চেষ্টা করল না।
বন্দিদের দিকে চেয়ে খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে ইনডিয়ানদের। বিজাতীয় ভাষায় কথা বলছে, তার এক বর্ণও বুঝল না অভিযাত্রীরা।
জংলীদের সারা গা খালি, কোমরের কাছে কিছু পাতা বেশ কায়দা করে জড়িয়েছে, সুন্দর ঝালরের মত ঘিরে রেখেছে সেই বিচিত্র পোশাক। ঝাল বানানোর আগে পাতাগুলোকে লাল আর হলুদ রঙে রাঙিয়ে নিয়েছে। একই ধরনের ছোট ঝালর জড়িয়েছে গোড়ালি আর বাজুতে। একজনের মাথায় লতার। বন্ধনীতে পাখির দুটো পালক গোঁজা। বোঝা যাচ্ছে, সে দলটার নেতা। লোকটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল জিম, কি চাও?
ইংরেজি বোঝার কথা নয় জংলীটার, কিন্তু বোধহয় অনুমান করে নিয়েই। জঙ্গলের দিকে হাত তুলে তার ভাষায় বলল কিছু। তারপর ইশারায় হাটার নির্দেশ দিল বন্দিদের।
ইনডিয়ানদের হাতের জ্বলন্ত মশালের আলোয় বুনোপথ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদেরকে? ফিসফিস করে জানতে চাইল জিনা। ওদের রাজার কাছে?
তাছাড়া আর কোথায়? তিক্ত হাসি হাসল ওরটেগা। নিজের ওপর মহা খাপ্পা। শালার ঘুম আর রাখতে পারলাম না। তা না হলে…
তা না হলেও কিছু করতে পারতেন না, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। এটা বরং ভালই হলো। জেগে থাকলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করতেন, আরও খারাপ হত তাহলে।
ঠিকই, কিশোরের কথা মেনে নিল ওরটেগা, দলে অনেক ভারি ইনডিয়ানরা।
ঘন বনের ভেতর দিয়ে সরু একটা পায়ে চলা পথ ধরে এগোচ্ছে ওরা। বিশ্রাম নেয়ায় রবিনের পায়ের ফোলা অনেক কমেছে, কিন্তু সবার সঙ্গে তাল। মিলিয়ে চলতে গিয়ে আবার ব্যথা শুরু হয়েছে। তার মনে হলো, শ-খানেক বছর
একটানা চলে লক্ষ লক্ষ মাইল বুনোপথ পেরোনোর পর একটা খোলা জায়গায়। বেরোল। ছোট ছোট অসংখ্য কুঁড়ে, গাছের ডালপাতা দিয়ে তৈরি। জিভারো ইনডিয়ানদের গ্রাম।
মাঝখানের কুঁড়েটা আশপাশেরগুলোর চেয়ে বড়। বন্দিদেরকে ওটার দিকে নিয়ে চলল জংলীরা।
বিশাল এক ইনডিয়ান বেরিয়ে এল বড় কুঁড়েটার দরজায়, গায়েগতরে যেন একটা দৈত্য। মাথায় টিউকান পাখির পালক গোঁজা। বোঝা গেল, সে-ই রাজা। কিংবা সর্দার।
তার দিকে বন্দিদের ঠেলে দিল জংলীরা।
লোকটার বয়েস যে কত হয়েছে কে জানে, একশো থেকে দেড়শোর মাঝে যা। খুশি হতে পারে। ছেলেমেয়েদের দেখে অবাক হয়েছে সে। তাদের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ, তারপর আদেশ দিল কিছু। গমগমে ভারি কণ্ঠ, মেঘ। ডাকল যেন।
দু-দলে ভাগ করে ফেলা হলো বন্দিদের। হাইজ্যাকাররা একদিকে, ছেলেমেয়েরা অন্যদিকে। দু-দিক থেকে প্রত্যেকেরই হাত চেপে ধরল দুজন করে ইনডিয়ান। বন্দিরা. ভাবল, তাদের শেষ সময় উপস্থিত। ভয়ে আতঙ্কে কাঁপছে সবার বুক।
কিন্তু মারল না তাদেরকে ইনডিয়ানরা। টেনে নিয়ে চলল। একটা খালি কুঁড়েতে ছেলেদের ঠেলে দেয়া হলো, হাইজ্যাকারদেরকে আরেকটা কুঁড়েতে। তারপর বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল জংলীরা।
তিন গোয়েন্দা আর জিনার সঙ্গেই রয়েছে রাফিয়ান।