কাছে এগোল ছেলেরা। উঁকি দিয়ে দেখল, ভ্যানের দেয়াল ঘেঁষে একটা আলমারি বসানো। একটা গ্যাসের চুলা আর ছোট একটা রেফ্রিজারেটরও রয়েছে। আর আছে একটা বিছানা, নিখুঁতভাবে বিছানো। অবাক হয়ে ছেলেরা ভাবল, শুকনো ঢেঙা লোকটা ওই ভ্যানের মধ্যেই বাস করে নাকি?
ছেলেদের দেখে ভ্রুকুটি করল লোকটা। তোমরাও ভাল বলবে না।
চেঁচাতে শুরু করল কে জানি।
ডাক্তার জর্জ হ্যারিসন। জানালাশূন্য নতুন বাড়িটার বাইরে দাঁড়িয়ে মুঠো পাকিয়ে শাসাচ্ছেন কাউকে। চেঁচিয়ে বললেন, তুমি..তুমি একটা। জন্তু!
ডাবলডোর খুলে গেল, দরজায় দেখা দিল ম্যাকম্বার। হাতের শটগান নেড়ে কড়া গলায় বলল, ভাগো! যাও এখান থেকে!
পিছিয়ে এলেন হ্যারিসন। জন্মের পর পরই খাঁচায় ভরা উচিত ছিল তোমাকে, জন্তু কোথাকার। ভেবেছ কি তুমি, অ্যাঁ? তোমার জায়গায় পাওয়া গেছে বলেই কি ওই হাড় তোমার সম্পত্তি? কেন, তোমার জায়গায় আলোও তো আছে, বাতাস আছে, রোদ আছে, ওগুলোও কি তোমার হয়ে গেল? ওই হোমিনিডটা আটকে রাখার কোন অধিকার নেই তোমার।
ভাল হবে না বলে দিচ্ছি, পাল্টা জবাব দিল ম্যাকম্বার।বেআইনীভাবে ঢুকেছ আমার জায়গায়, মাফ করে দিলাম। ভাগো এখন। দেখতে চাইলে কাল এসো। আর সবার মত পাঁচ ডলারের। টিকেট কিনে। যাও।
গলা টিপে ধরেছে যেন কেউ, এমনভাবে ফাঁসাস করে উঠলেন হ্যারিসন। ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে গটমট করে হাঁটতে শুরু করলেন।
হেসে ছেলেদের বলল ম্যাকম্বার, খুব রেগেছে।
উচিত হচ্ছে না! গোঁ গোঁ করে বলল ভ্যানের মালিক।
তোমাকে কে জিজ্ঞেস করছে? ধমক দিল ম্যাকম্বার। তোমার। কাজ তুমি করো। এই যে, ছেলেরা, আসবে নাকি। দেখতে চাও, কেমন সাজিয়েছি?
ঘুরে ভেতরে ঢুকে গেল আবার ম্যাকম্বার।
ছেলেরা গেল তার পেছনে। ভেতরে ঢুকেই হা হয়ে গেল।
জাদুঘর সাজিয়েছে বটে ম্যাকম্বার। বড় বড় ছবি। হাড় আর কঙ্কালের ছবি আছে, এনলার্জ করা ফটোগ্রাফ আছে। আছে নানারকম রঙিন ছবি, আদিম পৃথিবীর প্রাকৃতিক দৃশ্য। জলাভূমি থেকে বাষ্প উঠছে, উঁচু পাহাড় থেকে ঝরে পড়ছে ঝর্না, রুক্ষ সৈকতে ভাঙছে সাগরের ঢেউ-মাথায় ফেনার মুকুট।
ঘরের মাঝখানে অনেকগুলো টেবিল। তার ওপর সাজানো কাঁচের বাক্সে নানারকম প্রতিকৃতি। কোথাও বরফযুগের দৃশ্য, বরফে ঢেকে রেখেছে আমেরিকার একাংশ, কোথাও গলতে শুরু করেছে বরফ। বেরিয়ে পড়েছে গভীর হ্রদ, উঁচু উপত্যকা। একটা বাক্সে দেখা গেল। কয়েকজন উলঙ্গ রেড ইনডিয়ান শীত থেকে বাঁচার জন্যে আগুনের কাছে জড়সড় হয়ে আছে। আরেকটা বাক্সে বিশাল এক রোমশ ম্যামথ। হাতিকে আক্রমণ করেছে গুহামানবের দল।
ক্লাসিক হয়েছে, না? গর্বের হাসি ফুটল ম্যাকম্বারের মুখে। আসল জিনিস ওই ওদিকে।
দরজার ঠিক উল্টো দিকে একটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে, চারটে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। মঞ্চের পরে পাহাড়ের উলঙ্গ ঢাল, তাতে রয়েছে সেই গুহামুখটা। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত প্রবেশপথ।
সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠল তিন গোয়েন্দা। গুহামুখ দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল।
দম বন্ধ করে ফেলল কিশোর।
কেঁপে উঠল রবিন।
পুরো কঙ্কালটা নেই, আংশিক। খুলির বেশির ভাগই রয়েছে, কালের ক্ষয়ে বাদামী, কুৎসিত। বীভৎস ভঙ্গিতে যেন তাকিয়ে রয়েছে শূন্য অক্ষিকোটর। ওপরের চোয়ালটা আছে, মাঢ়ীতে বিকট দাঁতের সারি। গুহার মেঝে থেকে ঠেলে বেরিয়ে আছে মাটিতে গাঁথা পাঁজরের কয়েকটা হাড়। তার নিচে শ্রোণীর হাড়ের খানিকটা, তারও নিচে পায়ের কয়েকটা হাড়। একটা হাতের হাড় লম্বা হয়ে পড়ে আছে, পাঁচ আঙুলের তিনটে উধাও, দুটো রয়েছে একেবারে গুহামুখের ধারে। যেন মৃত্যুর আগে হাত বাড়িয়ে কিছু ধরার চেষ্টা করছিল।
গুহার ছাতে আলো ঝোলানো হয়েছে। কঙ্কালের কাছে জ্বলছে একটা কৃত্রিম অগ্নিকুণ্ড। তারও পরে যেন নিতান্ত অবহেলায় ফেলে রাখা হয়েছে কয়েকটা ন্যাভাজো কম্বল আর ইনডিয়ান কায়দায় তৈরি বেতের ঝুড়ি।
ডাক্তার হ্যারিসনের রাগের কারণ বুঝতে অসুবিধে হলো না ছেলেদের। আদিম রূপ দিতে গিয়ে পুরো ব্যাপারটাকেই হাস্যকর করে তুলেছে ম্যাকম্বার, অনেক কিছু বেমানান। চোখে আরও লাগে কঙ্কালের। চারপাশে আধুনিক বুটের অসংখ্য ছাপ। বোধহয় ইলেকট্রিশিয়ান আর টেকনিশিয়ানদের জুতোর।
কেমন বুঝছ? হেসে জিজ্ঞেস করল ম্যাকম্বার। আচ্ছা, আরেক কাজ করলে কেমন হয়? একজোড়া মোকাসিন যদি রেখে দিই ওটার পায়ের কাছে? ভাবখানা, জুতো খুলে শুয়েছে, ঘুমিয়ে পড়েছে? প্রশ্নের জবাব নিজে নিজেই দিল আবার। না, ভাল হবে না। বেমানান লাগবে।
অস্ফুট শব্দ বেরোল রবিনের মুখ থেকে।
আবার বলল ম্যাকম্বার, আমার মনে হয় না, এত আগে মোকাসিন পরত মানুষ। না?
জবাব দিল না ছেলেরা।
ঘুরে মঞ্চ থেকে নেমে আরেকদিকে রওনা হলো। এক জায়গায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেকগুলো চকচকে রিঙ, তাতে খাটো শেকল দিয়ে আটকানো প্লাস্টিকের গুহামানবের প্রতিকৃতি। কিছু টি-শার্ট আছে, বুকে গুহামানবের ছবি ছাপা।
ওগুলো বিক্রির জন্যে, জানাল ম্যাকম্বার। আজ তো দিতে পারবে না, বিক্রি শুরু হয়নি। কাল এসো।…চলো, বেরোই। সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দরজার দিকে এগোল সে। চলতে চলতেই বলল, দরজায় তালা লাগিয়ে রাখব। রাতে পাহারা দেবে জিপসিটা।